এফটিএসই

এফটিএসই : একটি বিস্তারিত আলোচনা

এফটিএসই (Financial Times Stock Exchange) হলো বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি মূলত যুক্তরাজ্যের স্টক মার্কেটের কর্মক্ষমতা নির্দেশ করে। এই সূচকটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি, যা বাজারের গতিবিধি বুঝতে এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক। এই নিবন্ধে, এফটিএসই-এর গঠন, ইতিহাস, গণনা পদ্ধতি, বিনিয়োগের সুযোগ এবং ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

এফটিএসই-এর ইতিহাস

এফটিএসই-এর যাত্রা শুরু হয় ১৯২২ সালে, যখন লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ (London Stock Exchange) প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ ইনডেক্স তৈরি করে। পরবর্তীতে, ১৯৮৪ সালে ফিনান্সিয়াল টাইমস এবং লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে এফটিএসই ১০০ ইনডেক্স চালু করে। এই সূচকটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চমার্ক হিসেবে পরিচিত হয়। সময়ের সাথে সাথে, এফটিএসই আরও বিভিন্ন ধরনের সূচক চালু করেছে, যা বিভিন্ন সেক্টর এবং বাজারের প্রতিনিধিত্ব করে।

এফটিএসই-এর প্রকারভেদ

এফটিএসই বিভিন্ন ধরনের সূচক প্রকাশ করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

এফটিএসই ১০০ (FTSE 100): এটি যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম ১০০টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত, যা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। এই সূচকটি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে। ব্লু চিপ স্টক এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এই সূচক।
এফটিএসই ২৫০ (FTSE 250): এফটিএসই ১০০-এর পরবর্তী বৃহত্তম ২৫০টি কোম্পানি নিয়ে এই সূচক গঠিত। এটি মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোর কর্মক্ষমতা নির্দেশ করে।
এফটিএসই ৩০০ (FTSE 350): এটি এফটিএসই ১০০ এবং এফটিএসই ২৫০ এর সম্মিলিত রূপ, যেখানে যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম ৩৫০টি কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত।
এফটিএসই অল-শেয়ার (FTSE All-Share): এই সূচকে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রায় ৯৮% কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটি যুক্তরাজ্যের সামগ্রিক স্টক মার্কেটকে প্রতিনিধিত্ব করে।
এফটিএসই ১০০ ইনডেক্স অপশনস (FTSE 100 Index Options): এই অপশনগুলি এফটিএসই ১০০ সূচকের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এবং বিনিয়োগকারীদের বাজারের ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দেয়। ডেরিভেটিভ মার্কেট এর একটি অংশ এটি।

এফটিএসই সূচকের তালিকা
সূচকের নাম	অন্তর্ভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা	প্রতিনিধিত্ব	এফটিএসই ১০০	১০০	বৃহত্তম কোম্পানি	এফটিএসই ২৫০	২৫০	মাঝারি আকারের কোম্পানি	এফটিএসই ৩০০	৩৫০	বৃহত্তম ও মাঝারি আকারের কোম্পানি	এফটিএসই অল-শেয়ার	প্রায় ৯৮%	সামগ্রিক স্টক মার্কেট

এফটিএসই কিভাবে গণনা করা হয়?

এফটিএসই সূচক গণনা করার পদ্ধতিটি ওয়েটেড গড় (Weighted Average) পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। এর মানে হলো, সূচক গণনার সময় প্রতিটি কোম্পানির বাজার মূলধন (Market Capitalization) বিবেচনা করা হয়। বাজার মূলধন হলো কোম্পানির শেয়ারের সংখ্যা এবং প্রতিটি শেয়ারের দামের গুণফল।

গণনার সূত্রটি নিম্নরূপ:

সূচক মান = (মোট বাজার মূলধন / ভিত্তি বছর বাজার মূলধন) × ১০০

এখানে,

মোট বাজার মূলধন হলো এফটিএসই-তে অন্তর্ভুক্ত সকল কোম্পানির বর্তমান বাজার মূলধনের যোগফল।
ভিত্তি বছর বাজার মূলধন হলো একটি নির্দিষ্ট বছর (সাধারণত সূচক শুরুর বছর) -এর বাজার মূলধন, যা সূচকের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।

এই পদ্ধতিতে, বৃহত্তর বাজার মূলধনের কোম্পানিগুলোর দামের পরিবর্তন সূচকের উপর বেশি প্রভাব ফেলে।

এফটিএসই-তে বিনিয়োগের সুযোগ

এফটিএসই-তে বিনিয়োগ করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে:

সরাসরি স্টক কেনা: বিনিয়োগকারীরা এফটিএসই ১০০ বা এফটিএসই ২৫০-এর অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার সরাসরি কিনতে পারেন।
ইটিএফ (ETF): এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (Exchange Traded Fund) হলো এমন একটি বিনিয়োগ তহবিল, যা একটি নির্দিষ্ট সূচককে অনুসরণ করে। এফটিএসই-এর উপর ভিত্তি করে অনেক ইটিএফ রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের সহজে এফটিএসই-তে বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়।
মিউচুয়াল ফান্ড: মিউচুয়াল ফান্ড হলো এমন একটি বিনিয়োগ মাধ্যম, যেখানে অনেক বিনিয়োগকারীর অর্থ একত্রিত করে বিভিন্ন ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ করা হয়। এফটিএসই-এর উপর ভিত্তি করে কিছু মিউচুয়াল ফান্ডও রয়েছে।
ফিউচার্স এবং অপশনস: এফটিএসই ১০০ ইনডেক্স ফিউচার্স এবং অপশনস ট্রেড করার সুযোগ রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের বাজারের ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। ফিউচার্স ট্রেডিং এবং অপশন ট্রেডিং সম্পর্কে ভালো জ্ঞান এক্ষেত্রে প্রয়োজন।
সিএফডি (CFD): কনট্রাক্টস ফর ডিফারেন্স (Contracts for Difference) একটি জনপ্রিয় ট্রেডিং উপকরণ, যা বিনিয়োগকারীদের এফটিএসই-এর দামের উপর বাজি ধরতে দেয়।

এফটিএসই-তে বিনিয়োগের ঝুঁকি

এফটিএসই-তে বিনিয়োগের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত:

বাজার ঝুঁকি: স্টক মার্কেটের সাধারণ ঝুঁকি এফটিএসই-কেও প্রভাবিত করতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অন্য কোনো কারণে বাজার পড়লে এফটিএসই-এর মানও কমতে পারে।
কোম্পানি নির্দিষ্ট ঝুঁকি: এফটিএসই-তে অন্তর্ভুক্ত কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির খারাপ পারফরম্যান্স সূচকের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মুদ্রা ঝুঁকি: যেহেতু এফটিএসই মূলত পাউন্ড স্টার্লিং-এর (Pound Sterling) উপর ভিত্তি করে গঠিত, তাই মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তন বিনিয়োগের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তারল্য ঝুঁকি: কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ছোট কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনা বা বেচা কঠিন হতে পারে, যা তারল্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এফটিএসই-এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

এফটিএসই এবং বিশ্ব অর্থনীতি

এফটিএসই শুধু যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির দর্পণ নয়, এটি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। এফটিএসই-এর কর্মক্ষমতা বিশ্ব অর্থনীতির গতিবিধি, বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। অনেক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী এফটিএসই-কে তাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন।

এফটিএসই-এর টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ

এফটিএসই-এর গতিবিধি বোঝার জন্য টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ (Technical Analysis) একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। টেকনিক্যাল বিশ্লেষকরা বিভিন্ন চার্ট প্যাটার্ন, ট্রেন্ড লাইন এবং ইন্ডিকেটর (Indicator) ব্যবহার করে বাজারের ভবিষ্যৎ গতিবিধি прогнозировать চেষ্টা করেন। কিছু জনপ্রিয় টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর হলো:

মুভিং এভারেজ (Moving Average): এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেয়ারের গড় মূল্য দেখায়, যা ট্রেন্ড নির্ধারণে সহায়ক।
আরএসআই (RSI): রিলেটিভ স্ট্রেন্থ ইন্ডেক্স (Relative Strength Index) বাজারের অতিরিক্ত কেনা বা বিক্রির চাপ নির্দেশ করে।
এমএসিডি (MACD): মুভিং এভারেজ কনভারজেন্স ডাইভারজেন্স (Moving Average Convergence Divergence) দুটি মুভিং এভারেজের মধ্যে সম্পর্ক দেখায় এবং ট্রেডিং সংকেত প্রদান করে।
বলিঙ্গার ব্যান্ডস (Bollinger Bands): এটি বাজারের অস্থিরতা পরিমাপ করে এবং সম্ভাব্য ব্রেকআউট চিহ্নিত করে।
ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট (Fibonacci Retracement): এই টুলটি সম্ভাব্য সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল খুঁজে বের করতে সাহায্য করে।

এফটিএসই-এর ভলিউম বিশ্লেষণ

ভলিউম বিশ্লেষণ (Volume Analysis) এফটিএসই-এর গতিবিধি বোঝার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ভলিউম হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কেনা বা বেচার শেয়ারের সংখ্যা। উচ্চ ভলিউম সাধারণত শক্তিশালী ট্রেন্ড নির্দেশ করে, যেখানে নিম্ন ভলিউম দুর্বল ট্রেন্ড নির্দেশ করে।

অন ব্যালেন্স ভলিউম (OBV): এই ইন্ডিকেটরটি ভলিউম এবং মূল্যের মধ্যে সম্পর্ক দেখায়।
ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস (VWAP): এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ট্রেড করা শেয়ারের গড় মূল্য দেখায়, যা বাজারের গড় মূল্য নির্ধারণে সহায়ক।

এফটিএসই ট্রেডিং কৌশল

এফটিএসই-তে ট্রেড করার জন্য বিভিন্ন কৌশল রয়েছে:

ট্রেন্ড ফলোয়িং (Trend Following): এই কৌশলে বাজারের ট্রেন্ড অনুসরণ করা হয়। যদি বাজার বাড়তে থাকে, তবে কেনা হয়, এবং যদি কমতে থাকে, তবে বিক্রি করা হয়।
রেঞ্জ ট্রেডিং (Range Trading): এই কৌশলে বাজারের একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করা শেয়ার কেনা বা বেচা হয়।
ব্রেকআউট ট্রেডিং (Breakout Trading): যখন কোনো শেয়ার একটি নির্দিষ্ট রেজিস্ট্যান্স লেভেল অতিক্রম করে, তখন তাকে ব্রেকআউট বলা হয়। এই কৌশলে ব্রেকআউটের সময় ট্রেড করা হয়।
স্কাল্পিং (Scalping): এটি একটি স্বল্পমেয়াদী কৌশল, যেখানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছোট ছোট লাভ করা হয়।
সুইং ট্রেডিং (Swing Trading): এই কৌশলে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত শেয়ার ধরে রাখা হয়।

এফটিএসই এবং বাইনারি অপশন

বাইনারি অপশন (Binary Option) হলো একটি আর্থিক উপকরণ, যেখানে বিনিয়োগকারীরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো সম্পদের দাম বাড়বে নাকি কমবে সে বিষয়ে বাজি ধরেন। এফটিএসই-এর উপর ভিত্তি করে বাইনারি অপশন ট্রেড করা যায়। এক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এফটিএসই-এর দাম একটি নির্দিষ্ট স্তরের উপরে বা নিচে থাকবে কিনা তা прогнозировать করতে হয়।

উপসংহার

এফটিএসই বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। এই সূচকটি বাজারের গতিবিধি বুঝতে, বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে বের করতে এবং ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। তবে, এফটিএসই-তে বিনিয়োগ করার আগে এর গঠন, গণনা পদ্ধতি, ঝুঁকি এবং বিভিন্ন ট্রেডিং কৌশল সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত। টেকনিক্যাল এবং ভলিউম বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজারের পূর্বাভাস দিতে পারলে বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও বাড়ানো যায়।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ