ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন
ভূমিকা
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন বিদ্যুৎ চুম্বকত্ব-এর একটি মৌলিক নীতি। এই নীতির মাধ্যমে একটি পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে এবং এর ফলে কোনো বদ্ধ পরিpathায় বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হতে পারে। এই ঘটনাটি ১৮৩১ সালে মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন। এই ইন্ডাকশন প্রক্রিয়া আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে, যার মধ্যে বৈদ্যুতিক জেনারেটর, ট্রান্সফরমার, এবং ওয়্যারলেস চার্জিং উল্লেখযোগ্য।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের ইতিহাস
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের আবিষ্কারের পূর্বে, বিজ্ঞানীরা বিদ্যুৎ এবং চুম্বকত্বের মধ্যে একটি সম্পর্ক অনুভব করেছিলেন। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড ১৮২০ সালে আবিষ্কার করেন যে বিদ্যুৎ প্রবাহের পার্শ্বে একটি কম্পাস সুঁচ বিক্ষিপ্ত হয়, যা প্রমাণ করে যে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ফ্যারাডে এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান এবং দেখান যে একটি পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে।
ফ্যারাডে একটি কয়েলের মধ্যে একটি চুম্বক প্রবেশ করিয়ে এবং সরিয়ে ইন্ডাকশনের প্রথম পরীক্ষাটি করেন। তিনি দেখেন যে চুম্বকটি যখন কয়েলের দিকে অগ্রসর হয় বা যখন কয়েল থেকে দূরে সরে যায়, তখন কয়েলে একটি বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপন্ন হয়। এই পরীক্ষাটিই ফ্যারাডের ইন্ডাকশন সূত্র-এর ভিত্তি স্থাপন করে।
ফ্যারাডের ইন্ডাকশন সূত্র
ফ্যারাডের ইন্ডাকশন সূত্র অনুযায়ী, কোনো বদ্ধ পরিpathায় আবিষ্ট তড়িৎচালক বল (electromotive force বা EMF) ঐ পরিpathের সাথে জড়িত চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক। গাণিতিকভাবে এটি নিম্নরূপ প্রকাশ করা হয়:
EMF = -dΦ/dt
এখানে,
- EMF হলো আবিষ্ট তড়িৎচালক বল, যা ভোল্ট (Volt) এককে পরিমাপ করা হয়।
- Φ হলো চৌম্বক ফ্লাক্স, যা ওয়েবার (Weber) এককে পরিমাপ করা হয়।
- t হলো সময়, যা সেকেন্ড (second) এককে পরিমাপ করা হয়।
- ঋণাত্মক চিহ্নটি লেন্সের সূত্র নির্দেশ করে, যা বলে যে আবিষ্ট EMF এমনভাবে চালিত হয় যাতে এটি সেই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে যা এটিকে তৈরি করেছে।
চৌম্বক ফ্লাক্স (Φ) হলো কোনো পৃষ্ঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রের মোট পরিমাণ। এটিকে নিম্নলিখিতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়:
Φ = B⋅A⋅cosθ
এখানে,
- B হলো চৌম্বক ক্ষেত্র, যা টেসলা (Tesla) এককে পরিমাপ করা হয়।
- A হলো পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল, যা বর্গমিটার (square meter) এককে পরিমাপ করা হয়।
- θ হলো চৌম্বক ক্ষেত্র এবং পৃষ্ঠের অভিলম্বের মধ্যেকার কোণ।
ইন্ডাকশনের প্রকারভেদ
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন প্রধানত দুই প্রকার:
- স্ব-ইন্ডাকশন (Self-induction): যখন কোনো কয়েলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিবর্তিত হয়, তখন কয়েলের নিজের চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে কয়েলেই একটি EMF আবিষ্ট হয়, যা প্রবাহের পরিবর্তনকে বাধা দেয়। এই ঘটনাকে স্ব-ইন্ডাকশন বলে। স্ব-ইন্ডাকটেন্স (L) হলো আবিষ্ট EMF এবং প্রবাহের পরিবর্তনের হারের অনুপাত। L = EMF / (dI/dt)। ইনডাক্টর এই নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।
- পারস্পরিক ইন্ডাকশন (Mutual induction): যখন দুটি কয়েল কাছাকাছি রাখা হয় এবং একটি কয়েলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিবর্তিত হয়, তখন অন্য কয়েলে একটি EMF আবিষ্ট হয়। এই ঘটনাকে পারস্পরিক ইন্ডাকশন বলে। পারস্পরিক ইন্ডাকটেন্স (M) হলো একটি কয়েলে আবিষ্ট EMF এবং অন্য কয়েলের প্রবাহের পরিবর্তনের হারের অনুপাত।
ইন্ডাকশনের প্রয়োগ
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের অসংখ্য ব্যবহার রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ আলোচনা করা হলো:
- বৈদ্যুতিক জেনারেটর: জেনারেটর হলো এমন একটি যন্ত্র যা যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এটি ইন্ডাকশন নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। জেনারেটরের মধ্যে একটি কয়েলকে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ঘোরানো হয়, যার ফলে কয়েলে একটি EMF আবিষ্ট হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে এই জেনারেটর ব্যবহার করা হয়।
- ট্রান্সফরমার: ট্রান্সফরমার হলো এমন একটি যন্ত্র যা একটি ভোল্টেজ লেভেল থেকে অন্য ভোল্টেজ লেভেলে বিদ্যুৎ শক্তি স্থানান্তর করে। এটি দুটি কয়েলের মধ্যে পারস্পরিক ইন্ডাকশনের মাধ্যমে কাজ করে। ট্রান্সফরমারগুলি বিদ্যুৎ বিতরণ এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
- ওয়্যারলেস চার্জিং: ওয়্যারলেস চার্জিং হলো তারবিহীনভাবে কোনো ডিভাইসকে চার্জ করার প্রযুক্তি। এটি ইন্ডাকশন নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। একটি ট্রান্সমিটার কয়েল একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা একটি রিসিভার কয়েলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং ডিভাইসটিকে চার্জ করে। স্মার্টফোন, ইয়ারফোন এবং অন্যান্য পোর্টেবল ডিভাইসে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
- মেটাল ডিটেক্টর: মেটাল ডিটেক্টর ইন্ডাকশন নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এটি একটি কয়েলের মাধ্যমে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে এবং ধাতব বস্তুর উপস্থিতি সনাক্ত করে। ধাতব বস্তু চৌম্বক ক্ষেত্রকে perturb করে, যা ডিটেক্টর দ্বারা সনাক্ত করা হয়। নিরাপত্তা এবং খনন কাজে এটি ব্যবহৃত হয়।
- ইন্ডাকশন হিটিং: এই পদ্ধতিতে, একটি কয়েলের মাধ্যমে একটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে ধাতব বস্তুকে উত্তপ্ত করা হয়। এটি শিল্পক্ষেত্রে এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
লেন্সের সূত্র এবং শক্তির সংরক্ষণ
লেন্সের সূত্র অনুসারে, আবিষ্ট EMF সবসময় এমন দিকে কাজ করে যাতে এটি সেই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে যা এটিকে সৃষ্টি করেছে। এর মানে হলো, যদি চৌম্বক ফ্লাক্স বাড়ছে হয়, তবে আবিষ্ট EMF এমন দিকে কাজ করবে যাতে ফ্লাক্স হ্রাস পায়, এবং যদি ফ্লাক্স কমছে হয়, তবে আবিষ্ট EMF এমন দিকে কাজ করবে যাতে ফ্লাক্স বৃদ্ধি পায়।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ নীতিও প্রযোজ্য। আবিষ্ট EMF দ্বারা সৃষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা সরবরাহ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, ইন্ডাকশন প্রক্রিয়ায় নতুন কোনো শক্তি তৈরি হয় না, কেবল শক্তির রূপান্তর ঘটে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সতর্কতা
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন নিয়ে কাজ করার সময় কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার:
- ফ্যারাডের সূত্র বোঝা: ইন্ডাকশনের মূলনীতি ভালোভাবে বুঝতে হবে।
- চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন: চৌম্বক ক্ষেত্র যত দ্রুত পরিবর্তিত হবে, আবিষ্ট EMF তত বেশি হবে।
- কয়েলের গঠন: কয়েলের পাকসংখ্যা এবং ক্ষেত্রফল EMF-এর মানকে প্রভাবিত করে।
- লেন্সের সূত্র মনে রাখা: আবিষ্ট EMF-এর দিক লেন্সের সূত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়।
- নিরাপত্তা: উচ্চ ভোল্টেজ এবং বিদ্যুৎ প্রবাহের সাথে কাজ করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
অতিরিক্ত আলোচনা
- হিস্টেরেসিস (Hysteresis): কিছু ক্ষেত্রে, চৌম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পরেও ইন্ডাকশন প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে না। এই বিলম্বকে হিস্টেরেসিস বলা হয়।
- এডি কারেন্ট (Eddy current): যখন কোনো পরিবাহী বস্তু একটি পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রাখা হয়, তখন বস্তুর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের লুপ তৈরি হয়, যা এডি কারেন্ট নামে পরিচিত।
- স্কিন এফেক্ট (Skin effect): উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে, বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিবাহীর পৃষ্ঠের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ থাকে, যা স্কিন এফেক্ট নামে পরিচিত।
উপসংহার
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন একটি শক্তিশালী এবং বহুল ব্যবহৃত নীতি। এটি আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নীতির সঠিক ধারণা এবং প্রয়োগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও উন্নত করতে সহায়ক।
| রাশি | প্রতীক | একক | সংজ্ঞা | আবিষ্ট তড়িৎচালক বল | EMF | ভোল্ট (V) | কয়েলে উৎপন্ন ভোল্টেজ | চৌম্বক ফ্লাক্স | Φ | ওয়েবার (Wb) | চৌম্বক ক্ষেত্রের মোট পরিমাণ | স্ব-ইন্ডাকটেন্স | L | হেনরি (H) | কয়েলের স্ব-ইন্ডাকশনের পরিমাপ | পারস্পরিক ইন্ডাকটেন্স | M | হেনরি (H) | দুটি কয়েলের মধ্যে পারস্পরিক ইন্ডাকশনের পরিমাপ | বিদ্যুৎ প্রবাহ | I | অ্যাম্পিয়ার (A) | পরিpathের মধ্যে ইলেকট্রনের প্রবাহ |
বিদ্যুৎ চুম্বকত্ব ফ্যারাডের সূত্র লেন্সের সূত্র বৈদ্যুতিক জেনারেটর ট্রান্সফরমার ওয়্যারলেস চার্জিং ইনডাক্টর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বিদ্যুৎ বিতরণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নিরাপত্তা খনন শিল্পক্ষেত্র চিকিৎসা হিস্টেরেসিস এডি কারেন্ট স্কিন এফেক্ট বিদ্যুৎ প্রকৌশল চৌম্বক ক্ষেত্র বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বিদ্যুৎ প্রবাহ স্ব-ইন্ডাকশন পারস্পরিক ইন্ডাকশন টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ভলিউম বিশ্লেষণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন মুভিং এভারেজ আরএসআই (RSI)
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
