ইকোনমিক ভ্যালু অ্যাডড
ইকোনমিক ভ্যালু অ্যাডড (Economic Value Added)
ইকোনমিক ভ্যালু অ্যাডড (ইভিএ) একটি আর্থিক কর্মক্ষমতা পরিমাপক, যা কোনো কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রকৃত অর্থনৈতিক মুনাফা তৈরি করছে কিনা তা নির্ধারণ করে। এটি অ্যাকাউন্টিং মুনাফার একটি উন্নত সংস্করণ, যা মূলধন ব্যয় (Cost of Capital) বিবেচনা করে। ইভিএ ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় করেন বেন গ্রাহাম এবং পরবর্তীতে স্টের্ন ভ্যালু ম্যানেজমেন্ট এটিকে আরও বিস্তৃত করে।
ইভিএ-র মূল ধারণা
ইভিএ-র মূল ধারণা হলো, একটি কোম্পানি শুধুমাত্র তখনই মূল্য তৈরি করে যখন তার আর্থিক মুনাফা (Accounting Profit) তার মূলধন ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়। অন্যভাবে বলা যায়, ইভিএ হলো সেই অতিরিক্ত মুনাফা যা একটি কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত রিটার্নের পরে অর্জন করে।
ইভিএ নিম্নলিখিত নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত:
- বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করা: বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের উপর একটি নির্দিষ্ট রিটার্ন আশা করে। ইভিএ এই প্রত্যাশিত রিটার্নকে হিসাবে নেয়।
- প্রকৃত অর্থনৈতিক মুনাফা পরিমাপ: ইভিএ শুধুমাত্র অ্যাকাউন্টিং মুনাফার উপর নির্ভর করে না, বরং মূলধন ব্যয়ের সুযোগ ব্যয়কেও (Opportunity Cost of Capital) বিবেচনা করে।
- মূল্য তৈরি করা: ইভিএ শুধুমাত্র তখনই ইতিবাচক হবে যখন কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য তৈরি করবে।
ইভিএ গণনা করার সূত্র
ইভিএ গণনা করার সূত্রটি হলো:
ইভিএ = নিট অপারেটিং মুনাফা আফটার ট্যাক্স (NOPAT) - (মূলধন × মূলধন ব্যয়)
এখানে,
- নিট অপারেটিং মুনাফা আফটার ট্যাক্স (NOPAT) হলো কর পরিশোধের পরে কোম্পানির পরিচালন মুনাফা। এটি আয় বিবরণী (Income Statement) থেকে পাওয়া যায়।
- মূলধন হলো কোম্পানির মোট বিনিয়োগিত মূলধন, যা উদ্বৃত্ত পত্র (Balance Sheet) থেকে পাওয়া যায়।
- মূলধন ব্যয় হলো মূলধনের উপর প্রত্যাশিত রিটার্নের হার। এটি সাধারণত ওয়েটেড এভারেজ কস্ট অফ ক্যাপিটাল (WACC) ব্যবহার করে গণনা করা হয়।
ইভিএ-র উপাদানসমূহ
ইভিএ গণনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হলো:
| উপাদান | বিবরণ | উৎস |
|---|---|---|
| নিট অপারেটিং মুনাফা আফটার ট্যাক্স (NOPAT) | কর পরিশোধের পরে পরিচালন মুনাফা। | আয় বিবরণী |
| মূলধন | কোম্পানির মোট বিনিয়োগিত মূলধন। | উদ্বৃত্ত পত্র |
| মূলধন ব্যয় (WACC) | মূলধনের উপর প্রত্যাশিত রিটার্নের হার। | আর্থিক বিশ্লেষণ |
| করের হার | কোম্পানির প্রযোজ্য করের হার। | আয় বিবরণী ও কর সংক্রান্ত তথ্য |
ইভিএ এবং অ্যাকাউন্টিং মুনাফার মধ্যে পার্থক্য
ইভিএ এবং অ্যাকাউন্টিং মুনাফার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটি টেবিলে এই পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
| বৈশিষ্ট্য | অ্যাকাউন্টিং মুনাফা | ইভিএ |
|---|---|---|
| মূলধন ব্যয় বিবেচনা | করে না | করে |
| সুযোগ ব্যয় বিবেচনা | করে না | করে |
| বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা | বিবেচনা করে না | বিবেচনা করে |
| প্রকৃত অর্থনৈতিক মুনাফা | পরিমাপ করে না | পরিমাপ করে |
| মূল্য সংযোজন | নির্দেশ করে না | নির্দেশ করে |
ইভিএ-র ব্যবহার
ইভিএ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন:
- কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন: ইভিএ কোনো কোম্পানির কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করার জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার। এটি ব্যবস্থাপকদের তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।
- বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত: বিনিয়োগকারীরা ইভিএ ব্যবহার করে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উচ্চ ইভিএ নির্দেশ করে যে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য তৈরি করছে।
- মূল্যায়ন: ইভিএ কোনো কোম্পানির মূল্য নির্ধারণ করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
- প্রণোদনা কাঠামো: ইভিএ ব্যবস্থাপকদের জন্য প্রণোদনা কাঠামো তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইভিএ-র সুবিধা এবং অসুবিধা
সুবিধা:
- বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রকৃত মূল্য তৈরি করার ক্ষমতা মূল্যায়ন করে।
- কোম্পানির কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের একটি সুস্পষ্ট চিত্র প্রদান করে।
- মূলধন ব্যয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে।
- দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।
অসুবিধা:
- ইভিএ গণনা করা জটিল হতে পারে।
- এটি অ্যাকাউন্টিং ডেটার উপর নির্ভরশীল, যা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।
- স্বল্পমেয়াদী ফলাফলের উপর বেশি জোর দেওয়া হতে পারে।
- শিল্প ভেদে ইভিএ-র মান ভিন্ন হতে পারে।
ইভিএ-র প্রয়োগক্ষেত্র
ইভিএ বিভিন্ন শিল্পে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেমন:
- উৎপাদন শিল্প: উৎপাদন শিল্পে, ইভিএ উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের দক্ষতা মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।
- আর্থিক পরিষেবা: আর্থিক পরিষেবা শিল্পে, ইভিএ বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদানের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।
- খুচরা বাণিজ্য: খুচরা বাণিজ্য শিল্পে, ইভিএ ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা এবং বিপণন কার্যক্রমের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।
- প্রযুক্তি শিল্প: প্রযুক্তি শিল্পে, ইভিএ গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) বিনিয়োগের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।
ইভিএ এবং অন্যান্য কর্মক্ষমতা পরিমাপক
ইভিএ ছাড়াও, আরও অনেক কর্মক্ষমতা পরিমাপক রয়েছে, যেমন:
- রিস্ক অ্যাডজাস্টেড রিটার্ন অন ক্যাপিটাল (RAROC): RAROC ঝুঁকি বিবেচনা করে বিনিয়োগের রিটার্ন পরিমাপ করে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা-এর সাথে সম্পর্কিত।
- রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (ROI): ROI বিনিয়োগের উপর রিটার্ন পরিমাপ করে। বিনিয়োগ বিশ্লেষণ-এর একটি মৌলিক ধারণা।
- পেব্যাক পিরিয়ড: পেব্যাক পিরিয়ড হলো বিনিয়োগের পরিমাণ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়। মূলধন বাজেট-এর একটি অংশ।
- নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (NPV): NPV ভবিষ্যতের নগদ প্রবাহের বর্তমান মূল্য পরিমাপ করে। ডিসকাউন্টেড ক্যাশ ফ্লো (DCF) বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- ইন্টারনাল রেট অফ রিটার্ন (IRR): IRR হলো সেই ডিসকাউন্ট হার যেখানে NPV শূন্য হয়। আর্থিক মডেলিং-এর একটি অংশ।
ইভিএ-র সীমাবদ্ধতা
ইভিএ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণা: ইভিএ একটি বিমূর্ত ধারণা, যা বোঝা কঠিন হতে পারে।
- ডেটার উপর নির্ভরশীলতা: ইভিএ অ্যাকাউন্টিং ডেটার উপর নির্ভরশীল, যা ভুল বা অসম্পূর্ণ হতে পারে।
- শিল্পের ভিন্নতা: বিভিন্ন শিল্পের জন্য ইভিএ-র মান ভিন্ন হতে পারে, তাই তুলনা করা কঠিন।
- স্বল্পমেয়াদী ফোকাস: ইভিএ প্রায়শই স্বল্পমেয়াদী ফলাফলের উপর বেশি জোর দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
ভবিষ্যতের প্রবণতা
ইভিএ-র ধারণাটি সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে, টেকসই ইভিএ (Sustainable EVA) এবং সামাজিক ইভিএ (Social EVA) এর মতো নতুন ধারণাগুলি জনপ্রিয় হচ্ছে। টেকসই ইভিএ পরিবেশগত এবং সামাজিক বিষয়গুলি বিবেচনা করে, যেখানে সামাজিক ইভিএ কোম্পানির সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন করে।
উপসংহার
ইকোনমিক ভ্যালু অ্যাডড (ইভিএ) একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কর্মক্ষমতা পরিমাপক, যা কোনো কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রকৃত অর্থনৈতিক মুনাফা তৈরি করছে কিনা তা নির্ধারণ করে। এটি ব্যবস্থাপকদের এবং বিনিয়োগকারীদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও ইভিএ একটি মূল্যবান হাতিয়ার যা কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কর্পোরেট ফিনান্স এবং আর্থিক পরিকল্পনা-এর ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।
মূলধন কাঠামো লভ্যাংশ নীতি আর্থিক ঝুঁকি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা পোর্টফোলিও তত্ত্ব কার্যকরী মূলধন ব্যবস্থাপনা ঋণ ব্যবস্থাপনা মার্জার এবং অধিগ্রহণ কর্পোরেট পুনর্গঠন আর্থিক প্রতিবেদন অডিট কর পরিকল্পনা নগদ প্রবাহ ব্যবস্থাপনা বাজেট প্রণয়ন আর্থিক পূর্বাভাস বৈশ্বিক অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতি সুদের হার বৈদেশিক বিনিময় হার
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
