ইউরোপীয় সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস
ইউরোপীয় সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস (European Sustainability Reporting Standards - ESRS)
ভূমিকা
ইউরোপীয় সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস (ESRS) হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) একটি নতুন কাঠামো, যা কোম্পানিগুলোকে তাদের পরিবেশগত, সামাজিক এবং গভর্নেন্স (Environmental, Social, and Governance - ESG) সম্পর্কিত প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করবে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো নন-ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং ডিরেক্টিভ (Non-Financial Reporting Directive - NFRD) এর পরিবর্তে এসেছে এবং কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং ডিরেক্টিভ (Corporate Sustainability Reporting Directive - CSRD)-এর অধীনে বাস্তবায়িত হবে। CSRD-এর লক্ষ্য হলো বিনিয়োগকারীদের এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের জন্য কোম্পানিগুলোর সাসটেইনেবিলিটি কার্যক্রম সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ এবং তুলনামূলক তথ্য সরবরাহ করা।
ESRS এর প্রেক্ষাপট
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা এবং ভোক্তারা এখন পরিবেশগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উপর বেশি জোর দিচ্ছেন। এর ফলে কোম্পানিগুলোর উপর তাদের সাসটেইনেবিলিটি কর্মক্ষমতা সম্পর্কে জবাবদিহি করার চাপ বাড়ছে। পূর্বে, বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন কাঠামো এবং মেট্রিক ব্যবহার করে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট করত, যা তথ্যের তুলনা করা কঠিন করে তুলত। ESRS এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি একক, সুসংহত রিপোর্টিং কাঠামো সরবরাহ করে। এটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (Sustainable Development Goals - SDGs) এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডগুলোর (যেমন গ্লোবাল রিপোর্টিং ইনিশিয়েটিভ (Global Reporting Initiative - GRI) এবং সাসটেইনেবিলিটি অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড (Sustainability Accounting Standards Board - SASB)) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
CSRD এবং ESRS এর মধ্যে সম্পর্ক
CSRD হলো মূল নির্দেশিকা যা কোম্পানিগুলোকে ESRS অনুসরণ করে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট করতে বাধ্য করে। CSRD-এর অধীনে, বৃহৎ কোম্পানি এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই ২০২৪ সালের মধ্যে তাদের প্রথম ESRS-ভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে, এই প্রয়োজনীয়তা ছোট এবং মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোর (Small and Medium-sized Enterprises - SMEs) জন্যও প্রযোজ্য হবে।
ESRS এর মূল উপাদান
ESRS-এ ১০টি স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে, যা তিনটি স্তম্ভের অধীনে বিভক্ত:
১. পরিবেশগত (Environmental) স্ট্যান্ডার্ড: এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো কোম্পানিগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের উপর প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ESRS E1: জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change) - গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, জলবায়ু ঝুঁকি এবং সুযোগ।
- ESRS E2: দূষণ (Pollution) - বায়ু, জল এবং মাটি দূষণ।
- ESRS E3: জল এবং সামুদ্রিক সম্পদ (Water and Marine Resources) - জলের ব্যবহার, নিষ্কাশন এবং প্রভাব।
- ESRS E4: জীববৈচিত্র্য এবং ইকোসিস্টেম (Biodiversity and Ecosystems) - জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব এবং পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা।
- ESRS E5: ব্যবহার এবং বৃত্তাকার অর্থনীতি (Use and Circular Economy) - কাঁচামালের ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা।
২. সামাজিক (Social) স্ট্যান্ডার্ড: এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো কোম্পানিগুলোর নিজস্ব কর্মী, ভ্যালু চেইন (value chain) এবং প্রভাবিত সম্প্রদায়গুলোর উপর প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ESRS S1: নিজস্ব কর্মী (Own Workforce) - কর্মীদের অধিকার, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা।
- ESRS S2: ভ্যালু চেইন কর্মী (Value Chain Workers) - সরবরাহকারীদের কর্মীদের অধিকার এবং কর্মপরিবেশ।
- ESRS S3: প্রভাবিত সম্প্রদায় (Affected Communities) - স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর সামাজিক প্রভাব এবং অবদান।
- ESRS S4: গ্রাহক (Customers) - গ্রাহকদের সুরক্ষা, ডেটা গোপনীয়তা এবং পণ্যের নিরাপত্তা।
৩. গভর্নেন্স (Governance) স্ট্যান্ডার্ড: এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং নৈতিক মান সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ESRS G1: ব্যবসায়িক মডেল (Business Model) - কোম্পানির ব্যবসায়িক মডেল এবং এর প্রভাব।
- ESRS G2: নিয়ন্ত্রণ (Controls) - অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা।
রিপোর্টিং প্রক্রিয়া
ESRS-এর অধীনে রিপোর্টিং প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং এতে নিম্নলিখিত ধাপগুলো অন্তর্ভুক্ত:
১. ম্যাটেরিয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট (Materiality Assessment): কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ESG বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো হলো সেই ক্ষেত্রগুলো যেখানে কোম্পানির সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ম্যাটেরিয়ালিটি নির্ধারণের জন্য একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
২. ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: চিহ্নিত ম্যাটেরিয়াল বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে প্রাসঙ্গিক ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। এই ডেটা সংগ্রহ করা এবং বিশ্লেষণ করার জন্য নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ডেটা ম্যানেজমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. রিপোর্ট তৈরি: সংগৃহীত ডেটা এবং বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে একটি ESRS-সম্মত রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। রিপোর্টে অবশ্যই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে কোন স্ট্যান্ডার্ডগুলো অনুসরণ করা হয়েছে এবং কোন ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে। রিপোর্ট লেখার নিয়মাবলী সম্পর্কে জানতে হবে।
৪. যাচাইকরণ (Assurance): CSRD অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোর ESRS রিপোর্টের উপর তৃতীয় পক্ষের দ্বারা যাচাইকরণ করা বাধ্যতামূলক। এই যাচাইকরণ নিশ্চিত করে যে রিপোর্টটি নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক। অডিট প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
ESRS বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
ESRS বাস্তবায়ন কোম্পানিগুলোর জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে:
- ডেটা उपलब्धता: প্রয়োজনীয় ESG ডেটা সংগ্রহ করা কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে ভ্যালু চেইনের ক্ষেত্রে।
- দক্ষতা এবং জ্ঞান: ESRS স্ট্যান্ডার্ডগুলো বোঝা এবং প্রয়োগ করার জন্য কোম্পানিগুলোর দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হবে।
- খরচ: ESRS রিপোর্টিং বাস্তবায়ন এবং যাচাইকরণের খরচ উল্লেখযোগ্য হতে পারে।
- জটিলতা: ESRS স্ট্যান্ডার্ডগুলো জটিল এবং বিভিন্ন কোম্পানির জন্য বিভিন্নভাবে প্রযোজ্য হতে পারে।
ESRS এর সুবিধা
চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, ESRS বাস্তবায়নের অনেক সুবিধা রয়েছে:
- বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা: ESG কর্মক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছতা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।
- ঝুঁকি হ্রাস: সাসটেইনেবিলিটি ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত এবং পরিচালনা করতে সহায়তা করে।
- ব্র্যান্ডের সুনাম বৃদ্ধি: পরিবেশগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করে ব্র্যান্ডের সুনাম বৃদ্ধি করে।
- দীর্ঘমেয়াদী মূল্য তৈরি: দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সাফল্য এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
- নিয়ন্ত্রক সম্মতি: CSRD-এর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে আইনি জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ
ESRS রিপোর্টিংয়ের সাথে সম্পর্কিত কিছু টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণের বিষয় আলোচনা করা হলো:
- গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বিশ্লেষণ: ESRS E1 স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ডেটা বিশ্লেষণ করতে হবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট এবং লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট এর মতো কৌশল ব্যবহার করে নির্গমন কমানোর সুযোগ খুঁজে বের করতে হবে।
- জলের ব্যবহার বিশ্লেষণ: ESRS E3 স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, জলের ব্যবহার এবং নিষ্কাশন ডেটা বিশ্লেষণ করে জলের অপচয় কমানোর উপায় বের করতে হবে। ওয়াটার স্ট্রেস ম্যাপ ব্যবহার করে জলের ঝুঁকির মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
- সরবরাহ চেইন বিশ্লেষণ: ESRS S2 স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, সরবরাহ চেইনের কর্মীদের অধিকার এবং কর্মপরিবেশ মূল্যায়ন করতে হবে। সরবরাহ চেইন ডিলিজেন্স এবং ঝুঁকি ম্যাপিং এর মাধ্যমে দুর্বলতা চিহ্নিত করতে হবে।
- ম্যাটেরিয়ালিটি ম্যাট্রিক্স: ম্যাটেরিয়ালিটি অ্যাসেসমেন্টের ফলাফল একটি ম্যাট্রিক্সে উপস্থাপন করা যেতে পারে, যা কোম্পানিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ESG বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
- স্টেকহোল্ডার বিশ্লেষণ: স্টেকহোল্ডারদের প্রত্যাশা এবং উদ্বেগের মূল্যায়ন করার জন্য স্টেকহোল্ডার বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতের প্রবণতা
ESRS ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধীরে ধীরে এই স্ট্যান্ডার্ডগুলোর পরিধি বাড়াচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলোও অনুরূপ কাঠামো গ্রহণ করতে উৎসাহিত হচ্ছে। ডাবল ম্যাটেরিয়ালিটি এর ধারণা ভবিষ্যতে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে, যেখানে কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমের উপর পরিবেশ এবং সমাজের প্রভাব এবং পরিবেশ ও সামাজিক বিষয়গুলো তাদের ব্যবসার উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে তা বিবেচনা করতে হবে। এছাড়াও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence - AI) এবং ব্লকচেইন (Blockchain) এর মতো প্রযুক্তিগুলো ESRS রিপোর্টিংকে আরও নির্ভুল এবং স্বচ্ছ করতে সাহায্য করতে পারে।
উপসংহার
ইউরোপীয় সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস (ESRS) কোম্পানিগুলোর জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ নিয়ে এসেছে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো অনুসরণ করে, কোম্পানিগুলো তাদের সাসটেইনেবিলিটি কর্মক্ষমতা উন্নত করতে, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং দীর্ঘমেয়াদী মূল্য তৈরি করতে পারবে। ESRS বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা, ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের জন্য দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য।
আরও জানতে:
- Corporate Sustainability Reporting Directive (CSRD)
- European Commission - ESRS
- GRI Standards
- SASB Standards
- UN Sustainable Development Goals
- Materiality Assessment
- Data Management
- Audit Process
- Carbon Footprint
- Life Cycle Assessment
- Water Stress Map
- Supply Chain Due Diligence
- Risk Mapping
- Double Materiality
- Artificial Intelligence in ESG
- Blockchain in ESG
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- নন-ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং ডিরেক্টিভ (NFRD)
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
