ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থা

ভূমিকা

ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থা হলো একটি প্রাচীন এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি। এটি প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিসে উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে আরব বিশ্বে উন্নতি লাভ করে। ইউনানি চিকিৎসা শুধুমাত্র রোগ নিরাময়ের ওপর জোর দেয় না, বরং মানুষের শরীর ও মনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এই চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত প্রাকৃতিক উপাদান এবং জীবনযাত্রার সঠিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

ইতিহাস

ইউনানি চিকিৎসার ইতিহাস প্রাচীন গ্রিসের সাথে সম্পর্কিত। হিপোক্রেটিসকে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০) ইউনানি চিকিৎসার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি রোগকে ঐশ্বরিক ক্রোধের ফল হিসেবে না দেখে প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। হিপোক্রেটিস এবং তাঁর অনুসারীরা রোগের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

ইসলামিক স্বর্ণযুগে ইউনানি চিকিৎসা আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। মুসলিম বিজ্ঞানীরা গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থগুলি আরবিতে অনুবাদ করেন এবং তাতে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান যুক্ত করেন। ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) ছিলেন এই সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী ইউনানি চিকিৎসক। তাঁর লেখা ‘আল-কানুন ফি আল-তিব’ (The Canon of Medicine) দীর্ঘকাল ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ভারতবর্ষে ইউনানি চিকিৎসা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আসে এবং ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে। হযরত বু আলী শাহ-কে ভারতীয় উপমহাদেশে ইউনানি চিকিৎসার প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ইউনানি চিকিৎসা প্রচলিত রয়েছে।

মূলনীতি

ইউনানি চিকিৎসার মূল ভিত্তি হলো চারটি উপাদান - বাতাস, পানি, আগুন এবং মাটি। এই উপাদানগুলো মানবদেহে বিভিন্ন অনুপাতে বিদ্যমান থাকে এবং এদের ভারসাম্য বজায় রাখা সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ইউনানি বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের শরীরে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

ইউনানি চিকিৎসার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো:

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সমন্বয়।
রোগের কারণ নির্ণয়ের জন্য রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা।
প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস।
জীবনযাত্রার সঠিক পদ্ধতি, যেমন - খাদ্য, ঘুম, ব্যায়াম এবং মানসিক প্রশান্তি।

রোগ নির্ণয়

ইউনানি চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করা হয়:

পালস নির্ণয় (Nadi Pariksha): রোগীর নাড়ির গতি ও স্পন্দন পর্যবেক্ষণ করে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হয়।
মূত্র পরীক্ষা (Mutra Pariksha): রোগীর মূত্রের রং, গন্ধ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে রোগের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়।
মল পরীক্ষা (Baras Pariksha): রোগীর মলের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে হজমক্ষমতা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে জানা যায়।
দৃষ্টি পরীক্ষা (Look Pariksha): রোগীর ত্বক, চোখ, জিহ্বা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে রোগের লক্ষণ সনাক্ত করা হয়।
শ্রবণ পরীক্ষা (Sound Pariksha): রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন শুনে শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়।
রোগীর ইতিহাস (Patient History): রোগীর পূর্ববর্তী রোগ, পারিবারিক ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার বিবরণ সংগ্রহ করা হয়।

চিকিৎসা পদ্ধতি

ইউনানি চিকিৎসায় রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

herbal medicine (জড়িবুটি চিকিৎসা): ইউনানি চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়। এই উদ্ভিদগুলি থেকে তৈরি ওষুধ রোগ নিরাময়ে সহায়ক।
Diet therapy (খাদ্য চিকিৎসা): রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী খাদ্যতালিকা তৈরি করা হয়। সঠিক খাদ্য গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Regimenal therapy (রিজিমনাল থেরাপি): এই পদ্ধতিতে শরীরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করা হয়, যেমন - ভমন, বিরেচন, রক্তমোক্ষণ এবং হজম.
Massage (মালিশ): মালিশের মাধ্যমে শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখা এবং মাংসপেশি শিথিল করা হয়।
Exercise (ব্যায়াম): নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সক্রিয় রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
Hydrotherapy (জল চিকিৎসা): জল ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময় করা হয়।
Venesection (রক্তমোক্ষণ): নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত অপসারণের মাধ্যমে শরীরের দূষিত পদার্থ দূর করা হয়।
Cupping (কাপিং): ত্বকের নিচে বায়ুচাপের মাধ্যমে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করা হয়।

ইউনানি ওষুধের প্রকারভেদ

ইউনানি ওষুধকে সাধারণত নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা হয়:

Simple medicine (সাধারণ ওষুধ): একটি মাত্র উপাদান দিয়ে তৈরি ওষুধ।
Compound medicine (যৌগিক ওষুধ): একাধিক উপাদান মিশ্রিত করে তৈরি ওষুধ।
Standardized medicine (মানসম্মত ওষুধ): নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী তৈরি ওষুধ।
Traditional medicine (ঐতিহ্যবাহী ওষুধ): প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি ওষুধ।

ইউনানি ওষুধের কিছু উদাহরণ
উপাদান \| ব্যবহার \|	আজওয়াইন, মধু \| হজমের সমস্যা, পেটে গ্যাস \|	জিরা, মৌরি, আদা \| পেটের ব্যথা, বদহজম \|	বাদাম \| ত্বক ও চুলের যত্নে, কোষ্ঠকাঠিন্য \|	যব \| ডায়রিয়া, পেটের দুর্বলতা \|	কর্পূর \| হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট \|

ইউনানি চিকিৎসার আধুনিকীকরণ

বর্তমানে ইউনানি চিকিৎসা আধুনিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইউনানি ওষুধের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা যাচাই করা হচ্ছে। আয়ুর্বেদ এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে ইউনানি চিকিৎসার সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা চলছে।

সীমাবদ্ধতা

ইউনানি চিকিৎসার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই চিকিৎসাব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ এবং কিছু রোগের ক্ষেত্রে দ্রুত ফল পাওয়া যায় না। এছাড়াও, ইউনানি ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সহজলভ্যতা একটি বড় সমস্যা।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ইউনানি চিকিৎসার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক এবং বিকল্প চিকিৎসার চাহিদা বাড়ছে, এবং এই প্রেক্ষাপটে ইউনানি চিকিৎসা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিতে পারে। ইউনানি ওষুধের গবেষণা এবং উন্নয়নে আরও বেশি বিনিয়োগ করা উচিত, যাতে এই চিকিৎসাব্যবস্থা আরও কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্য হয়।

আরো দেখুন

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ