অ্যাডাম স্মিথ

অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন একজন স্কটিশ অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক এবং লেখক। তিনি ১৭২৩ সালের ৫ জুন স্কটল্যান্ডের Kirkcaldy তে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৯0 সালের ১৭ জুলাই এডিনবরায় মারা যান। স্মিথকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’ (১৭৭৬), যা অর্থনীতির ওপর লেখা একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতিগুলি ব্যাখ্যা করেছেন এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধারণা প্রদান করেছেন।

জীবনী

অ্যাডাম স্মিথের প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা স্কটল্যান্ডে কাটে। তিনি Kirkcaldy Grammar School এ এবং পরবর্তীতে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি নৈতিক দর্শন এবং দার্শনিক যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। ১৭৪৩ সালে তিনি এডিনবরায় যান এবং সেখানে নৈতিক দর্শন বিষয়ে লেকচার প্রদান করেন। ১৭৫৪ সালে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৭৬৪ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপনাকালে তিনি তাঁর প্রথম প্রধান কাজ ‘The Theory of Moral Sentiments’ (১৭৫৯) রচনা করেন।

১৭৬৪ সালে স্মিথ তাঁর অধ্যাপনাকার্য থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তী দশ বছর তিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। এই সময় তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিকদের সাথে পরিচিত হন। ফ্রান্সে থাকাকালীন তিনি ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তিনি স্কটল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং ‘The Wealth of Nations’ লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন।

The Theory of Moral Sentiments

অ্যাডাম স্মিথের প্রথম বই ‘The Theory of Moral Sentiments’ (১৭৫৯) নৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করে। এই গ্রন্থে তিনি মানুষের নৈতিক অনুভূতি এবং সামাজিক আচরণের উৎস অনুসন্ধান করেন। স্মিথ মনে করতেন, মানুষ সহানুভূতিশীল প্রাণী এবং অন্যের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম। তিনি ‘sympathy’ বা সহানুভূতির ধারণার ওপর জোর দেন, যা মানুষের নৈতিক বিচার এবং সামাজিকীকরণের ভিত্তি তৈরি করে। এই গ্রন্থে তিনি স্বার্থপরতা এবং পরোপকারিতার মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন এবং দেখান যে কীভাবে উভয়ই মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে।

The Wealth of Nations

অ্যাডাম স্মিথের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’ (১৭৭৬) অর্থনীতি শাস্ত্রের একটি মৌলিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি জাতীয় সম্পদ সৃষ্টির কারণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। স্মিথ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

শ্রম বিভাজন

স্মিথ ‘The Wealth of Nations’ গ্রন্থে শ্রম বিভাজনের ধারণাটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে যায়। একটি পিন তৈরির উদাহরণ দিয়ে তিনি শ্রম বিভাজনের সুবিধাগুলো তুলে ধরেন। তাঁর মতে, যখন কর্মীরা কোনো নির্দিষ্ট কাজের ওপর মনোযোগ দেয়, তখন তাদের দক্ষতা বাড়ে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

অদৃশ্য হাত

স্মিথ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘অদৃশ্য হাত’ (Invisible Hand) প্রবর্তন করেন। এই ধারণা অনুযায়ী, ব্যক্তি যখন নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করে, তখন অজান্তেই সে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখে। মুক্ত বাজারে ব্যক্তি তার নিজের লাভের জন্য কাজ করে, কিন্তু এর ফলে সামগ্রিকভাবে বাজারের সরবরাহ এবং চাহিদা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সমাজের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়।

মুক্ত বাজার অর্থনীতি

অ্যাডাম স্মিথ মুক্ত বাজার অর্থনীতির একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন। তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাজারের অবাধ কার্যক্রমের ওপর জোর দেন। তাঁর মতে, বাজারে চাহিদা ও যোগানের নিয়ম অনুসারে দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত এবং সরকার কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও মালিকানা অধিকার নিশ্চিত করবে। তিনি বণিজ্যবাদ (Mercantilism)-এর বিরোধিতা করেন এবং মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে মত দেন।

মূল্য তত্ত্ব

স্মিথ তাঁর গ্রন্থে মূল্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, কোনো পণ্যের মূল্য তার উৎপাদন খরচ এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। দীর্ঘমেয়াদে, পণ্যের মূল্য তার উৎপাদন খরচের সমান হয়। তিনি শ্রমের মূল্য তত্ত্বের ওপর জোর দেন, যেখানে শ্রমকে উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অর্থনৈতিক নীতিসমূহ

অ্যাডাম স্মিথ বেশ কিছু অর্থনৈতিক নীতি প্রস্তাব করেন যা আজও অর্থনীতিবিদদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের সীমিত হস্তক্ষেপ: স্মিথ মনে করতেন সরকারের উচিত অর্থনীতিতে কম হস্তক্ষেপ করা এবং বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া।
মুক্ত বাণিজ্য: তিনি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে ছিলেন এবং আমদানি ও রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের বিরোধিতা করতেন।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার: স্মিথ ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকারকে অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করতেন।
শ্রম বিভাজন: তিনি শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
বিনিয়োগের গুরুত্ব: স্মিথ বিনিয়োগকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য মনে করতেন।

স্মিথের চিন্তাধারার প্রভাব

অ্যাডাম স্মিথের চিন্তাধারা অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর ‘The Wealth of Nations’ বইটি অর্থনীতির ওপর লেখা সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁর ধারণাগুলো ধ্রুপদী অর্থনীতি (Classical Economics)-র ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং পরবর্তী অর্থনীতিবিদদের জন্য পথ খুলে দিয়েছে।

স্মিথের মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধারণা উদারনীতিবাদ (Liberalism)-এর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর চিন্তাধারা শিল্প বিপ্লবের সময়কালে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ছিল এবং আজও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।

সমালোচনা

অ্যাডাম স্মিথের চিন্তাধারা কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি মানুষের স্বার্থপরতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। আবার অনেকে তাঁর শ্রমের মূল্য তত্ত্বকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। তা সত্ত্বেও, অর্থনীতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।