অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং
অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং
অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং (Activity-Based Costing বা ABC) একটি আধুনিক খরচ হিসাব পদ্ধতি যা কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদন খরচের সঠিক হিসাব নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী খরচ হিসাব পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা দূর করে এবিসি ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এই নিবন্ধে, অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং-এর মূল ধারণা, প্রয়োগ প্রক্রিয়া, সুবিধা, অসুবিধা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
ভূমিকা ঐতিহ্যবাহী খরচ হিসাব পদ্ধতি, যেমন - কাজের অর্ডার কস্টিং বা প্রক্রিয়া কস্টিং, প্রায়শই ভুল খরচ বরাদ্দ করে। এর কারণ হলো এই পদ্ধতিগুলো সরাসরি শ্রম বা যন্ত্রের ব্যবহারের মতো অল্প কয়েকটি মাত্রার ওপর ভিত্তি করে খরচ বণ্টন করে। কিন্তু আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায়, পরোক্ষ খরচ (Indirect Costs) যেমন - সেটআপ খরচ, মান নিয়ন্ত্রণ খরচ, ডিজাইন খরচ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এবিসি এই পরোক্ষ খরচগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এবং সেগুলোকে কার্যক্রমের ভিত্তিতে পণ্য বা সেবার ওপর বরাদ্দ করে।
এবিসি-র মূল ধারণা এবিসি-র মূল ধারণা হলো, কোনো পণ্য বা সেবার খরচ নির্ধারণের জন্য প্রথমে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বিভিন্ন কার্যক্রম (Activities) চিহ্নিত করতে হবে। এরপর প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ নির্ধারণ করতে হবে। সবশেষে, এই খরচগুলো পণ্য বা সেবার ওপর ভিত্তি করে বরাদ্দ করতে হবে।
এবিসি কিভাবে কাজ করে? এবিসি পদ্ধতিতে সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
১. কার্যক্রম চিহ্নিতকরণ: প্রথম ধাপে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সমস্ত কার্যক্রম চিহ্নিত করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলো হতে পারে - কাপড় কাটা, সেলাই করা, মান নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং, ইত্যাদি। উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান এক্ষেত্রে জরুরি।
২. খরচ পুল তৈরি: এরপর, একই ধরনের কার্যক্রমগুলোকে একত্রিত করে খরচ পুল (Cost Pool) তৈরি করা হয়। প্রতিটি পুলের মধ্যে সেই কার্যক্রমগুলোর সম্মিলিত খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৩. কস্ট ড্রাইভার নির্বাচন: প্রতিটি খরচ পুলের জন্য একটি কস্ট ড্রাইভার (Cost Driver) নির্বাচন করা হয়। কস্ট ড্রাইভার হলো সেই উপাদান যা কার্যক্রমের খরচকে প্রভাবিত করে। যেমন - সেলাই কার্যক্রমের জন্য কস্ট ড্রাইভার হতে পারে সেলাইয়ের সংখ্যা, আর মান নিয়ন্ত্রণের জন্য হতে পারে পরিদর্শনের সংখ্যা। খরচ চালক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
৪. খরচ বরাদ্দ: কস্ট ড্রাইভারের ওপর ভিত্তি করে খরচগুলো পণ্য বা সেবার ওপর বরাদ্দ করা হয়। অর্থাৎ, প্রতিটি পণ্য বা সেবা কী পরিমাণ কার্যক্রম ব্যবহার করেছে, তার ওপর ভিত্তি করে খরচ বণ্টন করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ একটি পোশাক তৈরির এবিসি মডেল:
ধরা যাক, একটি পোশাক তৈরির কোম্পানি তিনটি ভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি করে - শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেট। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে, কোম্পানিটি কেবল সরাসরি শ্রম ও কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে খরচ হিসাব করত। কিন্তু এবিসি পদ্ধতিতে, কোম্পানিটি নিম্নলিখিত কার্যক্রমগুলো চিহ্নিত করে:
- কাপড় কাটা
- সেলাই করা
- মান নিয়ন্ত্রণ
- প্যাকেজিং
এরপর, প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য কস্ট ড্রাইভার নির্বাচন করা হয়:
- কাপড় কাটা: কাপড়ের পরিমাণ
- সেলাই করা: সেলাইয়ের সংখ্যা
- মান নিয়ন্ত্রণ: পরিদর্শনের সংখ্যা
- প্যাকেজিং: প্যাকেজের সংখ্যা
এবং প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য খরচ পুল তৈরি করা হয়। সবশেষে, কস্ট ড্রাইভারের ওপর ভিত্তি করে খরচগুলো শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেটের ওপর বরাদ্দ করা হয়।
| Cost Driver | Cost per Unit | Shirt | Pant | Jacket | | ||||
| কাপড়ের পরিমাণ | ১০ টাকা/মিটার | ২ মিটার | ২.৫ মিটার | ৩ মিটার | | সেলাইয়ের সংখ্যা | ৫ টাকা/সেলাই | ১০০ সেলাই | ১৫০ সেলাই | ২০০ সেলাই | | পরিদর্শনের সংখ্যা | ২ টাকা/পরিদর্শন | ২ পরিদর্শন | ৩ পরিদর্শন | ৪ পরিদর্শন | | প্যাকেজের সংখ্যা | ৩ টাকা/প্যাকেজ | ১ প্যাকেজ | ১ প্যাকেজ | ১ প্যাকেজ | | | | | | | |
এবিসি-র সুবিধা
- সঠিক খরচ হিসাব: এবিসি পণ্য বা সেবার প্রকৃত খরচ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
- উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সঠিক খরচ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থাপকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেমন - পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করা, ইত্যাদি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
- লাভজনকতা বিশ্লেষণ: এবিসি প্রতিটি পণ্য বা সেবার লাভজনকতা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।
- কার্যক্রমের উন্নতি: এবিসি কার্যক্রমগুলোর দক্ষতা মূল্যায়ন করতে এবং উন্নতির সুযোগ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
- রিসোর্স বরাদ্দ: এটি কোম্পানিকে তাদের রিসোর্সগুলো আরও কার্যকরভাবে বরাদ্দ করতে সাহায্য করে।
এবিসি-র অসুবিধা
- জটিলতা: এবিসি পদ্ধতিটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির চেয়ে জটিল। এটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করার জন্য বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন।
- ব্যয়বহুল: এবিসি পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন করতে বেশি সময় ও খরচ লাগতে পারে।
- ডেটা সংগ্রহ: এই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন হতে পারে।
- বিষয়ভিত্তিকতা: কস্ট ড্রাইভার নির্বাচন এবং কার্যক্রম চিহ্নিতকরণে বিষয়ভিত্তিকতা থাকতে পারে, যা ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে।
এবিসি এবং ঐতিহ্যবাহী খরচ হিসাব পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য
| বৈশিষ্ট্য | অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং (এবিসি) | ঐতিহ্যবাহী খরচ হিসাব পদ্ধতি | |---|---|---| | ভিত্তি | কার্যক্রম (Activities) | পরিমাণ (Volume) | | পরোক্ষ খরচ | সঠিকভাবে চিহ্নিত ও বরাদ্দ করা হয় | ভুলভাবে বরাদ্দ করা হয় | | কস্ট ড্রাইভার | ব্যবহার করা হয় | ব্যবহার করা হয় না | | জটিলতা | জটিল | সরল | | খরচ | ব্যয়বহুল | কম ব্যয়বহুল | | নির্ভুলতা | অধিক নির্ভুল | কম নির্ভুল | | সিদ্ধান্ত গ্রহণ | উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে | সীমিত সহায়তা করে |
এবিসি-র প্রয়োগ ক্ষেত্র এবিসি বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন -
- উৎপাদন শিল্প: যেখানে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয় এবং পরোক্ষ খরচ বেশি। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
- সেবা শিল্প: যেমন - ব্যাংক, বীমা, স্বাস্থ্যসেবা, ইত্যাদি।
- সরকারি সংস্থা: সরকারি পরিষেবাগুলোর খরচ নির্ধারণে।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: বিভিন্ন প্রোগ্রামের খরচ বিশ্লেষণ করতে।
এবিসি-র আধুনিক প্রবণতা
- টাইম-ড্রাইভেন এবিসি (Time-Driven ABC): এই পদ্ধতিতে, কার্যক্রমের খরচ পরিমাপ করার জন্য সময়ের ব্যবহার করা হয়।
- রিসোর্স কনসাম্পশন অ্যাকাউন্টিং (Resource Consumption Accounting): এই পদ্ধতিতে, প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত রিসোর্সগুলোর খরচ হিসাব করা হয়।
- প্রসেস কস্টিং-এর সাথে এবিসি-র সমন্বয়: কিছু কোম্পানি প্রসেস কস্টিং-এর সাথে এবিসি-র ধারণাগুলো একত্রিত করে ব্যবহার করে।
ভলিউম বিশ্লেষণ এবং এবিসি ভলিউম বিশ্লেষণ এবিসি পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বিভিন্ন কার্যক্রমের ভলিউম এবং খরচের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে, কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা এবং কার্যক্রমের দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং এবিসি টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবিসি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ডেটার গুণমান এবং নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতে সাহায্য করে। এটি ডেটা সংগ্রহের প্রক্রিয়া এবং কস্ট ড্রাইভারগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে ব্যবহৃত হয়।
কৌশলগত দিক এবিসি শুধুমাত্র একটি খরচ হিসাব পদ্ধতি নয়, এটি একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে। এটি কোম্পানিকে তাদের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো মূল্যায়ন করতে, উন্নতির সুযোগগুলো চিহ্নিত করতে এবং প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করতে সাহায্য করে।
উপসংহার অ্যাক্টিভিটি-বেসড কস্টিং একটি শক্তিশালী খরচ হিসাব পদ্ধতি যা আধুনিক ব্যবসায়িক পরিবেশে অপরিহার্য। যদিও এটি জটিল এবং ব্যয়বহুল, সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি কোম্পানিকে সঠিক খরচ নির্ধারণ, উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং লাভজনকতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।
আরও জানতে:
- খরচ হিসাব
- প্রबंधन হিসাব
- কস্ট ড্রাইভার
- উৎপাদন খরচ
- পরোক্ষ খরচ
- লাভজনকতা
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ
- উৎপাদন ব্যবস্থাপনা
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- কৌশলগত ব্যবস্থাপনা
- সময়-চালিত এবিসি
- রিসোর্স কনসাম্পশন অ্যাকাউন্টিং
- প্রসেস কস্টিং
- খরচ বরাদ্দ
- কার্যকলাপ ব্যবস্থাপনা
- গুণমান নিয়ন্ত্রণ
- সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা
- কার্যকারিতা মূল্যায়ন
- ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
