অ্যাকাউন্টিং বোর্ড
অ্যাকাউন্টিং বোর্ড
ভূমিকা অ্যাকাউন্টিং বোর্ড, যা হিসাববিধি পরিষদ নামেও পরিচিত, একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এর কাজ হল আর্থিক প্রতিবেদন এবং হিসাব নিরীক্ষণের মান তৈরি করা এবং তত্ত্বাবধান করা। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে এবং আর্থিক বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই নিবন্ধে, অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের গঠন, কার্যাবলী, ইতিহাস, এবং আধুনিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের ইতিহাস অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের যাত্রা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ১৯৩৭ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাকাউন্ট্যান্টস (AICPA) প্রথম হিসাব মান নির্ধারণের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে, ১৯৪৩ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) গঠিত হওয়ার পর আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর সরকারি নজরদারি শুরু হয়। SEC-এর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু একটি সুসংহত এবং স্বাধীন হিসাব মান নির্ধারণী সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
১৯৭০ এর দশকে বিভিন্ন কর্পোরেট কেলেঙ্কারির পর, একটি স্বাধীন অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড সেটিং সংস্থার চাহিদা আরও জোরালো হয়। এর ফলস্বরূপ, ১৯৮০ সালে ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড (FASB) প্রতিষ্ঠিত হয়। FASB-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণভাবে গৃহীত হিসাব নীতি (GAAP) তৈরি করা, প্রচার করা এবং ব্যাখ্যা করা।
গঠন ও সদস্যবৃন্দ অ্যাকাউন্টিং বোর্ড সাধারণত একটি পরিচালনা পর্ষদ এবং বিভিন্ন কমিটি নিয়ে গঠিত হয়। এই পর্ষদে অ্যাকাউন্টিং পেশাজীবী, கல்வியাবিদ, এবং শিল্প বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। FASB-এর সাতজন পূর্ণকালীন সদস্য রয়েছে, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে কয়েকজন সদস্য অ্যাকাউন্টিং, অর্থায়ন, এবং ব্যবসায়িক আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন।
অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের কার্যাবলী অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের প্রধান কাজগুলো হলো:
- হিসাব মান নির্ধারণ: অ্যাকাউন্টিং বোর্ড আর্থিক প্রতিবেদনের জন্য হিসাব মান (Accounting Standards) তৈরি করে। এই মানগুলো কোম্পানিগুলোকে তাদের আর্থিক লেনদেন রেকর্ড এবং রিপোর্ট করতে সহায়তা করে।
- GAAP এর উন্নয়ন: সাধারণভাবে গৃহীত হিসাব নীতি (Generally Accepted Accounting Principles বা GAAP) তৈরি এবং নিয়মিতভাবে এর উন্নয়ন করা অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
- গবেষণা ও বিশ্লেষণ: বোর্ড বিভিন্ন অ্যাকাউন্টিং সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে এবং সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করে।
- পরামর্শ প্রদান: বিনিয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের অ্যাকাউন্টিং সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং মান (IFRS) এর সাথে GAAP এর সমন্বয় সাধনের জন্য অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতা করে।
GAAP এবং IFRS GAAP (Generally Accepted Accounting Principles) হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত হিসাব মান। অন্যদিকে, IFRS (International Financial Reporting Standards) হলো আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হিসাব মান। অ্যাকাউন্টিং বোর্ড GAAP তৈরি এবং বজায় রাখার জন্য দায়ী। তবে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিবেদনের সমন্বয় সাধনের জন্য FASB এবং IASB (International Accounting Standards Board) একসাথে কাজ করে।
হিসাব মান নির্ধারণের প্রক্রিয়া অ্যাকাউন্টিং বোর্ড একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হিসাব মান নির্ধারণ করে। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপগুলো নিয়ে গঠিত:
১. এজেন্ডা নির্ধারণ: বোর্ড কোন বিষয়ে কাজ করবে তা নির্ধারণ করে। ২. গবেষণা ও বিশ্লেষণ: সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা করা হয় এবং বিভিন্ন দিক বিবেচনা করা হয়। ৩. আলোচনা পত্র প্রকাশ: একটি আলোচনা পত্র (Discussion Paper) প্রকাশ করা হয়, যেখানে প্রস্তাবিত মান সম্পর্কে মতামত চাওয়া হয়। ৪. খসড়া মান প্রকাশ: প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে একটি খসড়া মান (Exposure Draft) প্রকাশ করা হয়। ৫. চূড়ান্ত মান গ্রহণ: প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে চূড়ান্ত মান গ্রহণ করা হয়।
অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের গুরুত্ব অ্যাকাউন্টিং বোর্ড আর্থিক বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর কয়েকটি প্রধান গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা: সঠিক হিসাব মান বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ভরযোগ্য আর্থিক তথ্য সরবরাহ করে, যা তাদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
- স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: অ্যাকাউন্টিং বোর্ড আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, যা কর্পোরেট গভর্নেন্সের জন্য অপরিহার্য।
- আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা: নির্ভরযোগ্য আর্থিক তথ্য আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- আন্তর্জাতিক তুলনা: IFRS-এর সাথে GAAP-এর সমন্বয় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক কর্মক্ষমতা তুলনা করতে সহায়ক।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের ভূমিকা বর্তমানে, অ্যাকাউন্টিং বোর্ডকে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- প্রযুক্তির প্রভাব: ফিনটেক এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে অ্যাকাউন্টিং ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
- পরিবেশগত, সামাজিক এবং গভর্নেন্স (ESG) রিপোর্টিং: বিনিয়োগকারীরা এখন ESG বিষয়গুলির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই অ্যাকাউন্টিং বোর্ডে ESG রিপোর্টিংয়ের জন্য নতুন মান তৈরি করতে হচ্ছে।
- সাইবার নিরাপত্তা: আর্থিক ডেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাইবার নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
- বৈশ্বিক মহামারী ও অর্থনৈতিক সংকট: কোভিড-১৯ এর মতো বৈশ্বিক মহামারী এবং অর্থনৈতিক সংকট আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর নতুন প্রভাব ফেলে, যা অ্যাকাউন্টিং বোর্ডকে বিবেচনায় নিতে হয়।
অ্যাকাউন্টিং এবং বিনিয়োগের মধ্যে সম্পর্ক অ্যাকাউন্টিং এবং বিনিয়োগ একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করতে আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে। অ্যাকাউন্টিং বোর্ড নিশ্চিত করে যে এই প্রতিবেদনগুলো যেন নির্ভরযোগ্য এবং তুলনামূলক হয়।
বিভিন্ন প্রকার হিসাব মান অ্যাকাউন্টিং বোর্ড বিভিন্ন ধরনের হিসাব মান তৈরি করে, যা বিভিন্ন শিল্প এবং লেনদেনের জন্য প্রযোজ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
- রাজস্ব স্বীকৃতি (Revenue Recognition): কখন এবং কীভাবে রাজস্ব স্বীকৃতি দিতে হবে, তা নির্ধারণ করে।
- লিজিং (Leasing): লিজিং চুক্তিগুলোর হিসাব treatment কিভাবে হবে, তার নির্দেশনা দেয়।
- আর্থিক উপকরণ (Financial Instruments): শেয়ার, বন্ড, এবং ডেরিভেটিভের মতো আর্থিক উপকরণগুলোর হিসাব treatment নিয়ে কাজ করে।
- সম্পত্তি, প্ল্যান্ট ও সরঞ্জাম (Property, Plant, and Equipment): স্থায়ী সম্পদের হিসাব treatment নির্ধারণ করে।
অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের ভবিষ্যৎ অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের ভবিষ্যৎ বেশ চ্যালেঞ্জিং। প্রযুক্তি, অর্থনীতি, এবং সামাজিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ESG রিপোর্টিং, ডিজিটাল সম্পদ, এবং সাইবার নিরাপত্তা - এই বিষয়গুলোতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। একই সাথে, GAAP এবং IFRS-এর মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
উপসংহার অ্যাকাউন্টিং বোর্ড আর্থিক বাজারের একটি অপরিহার্য অংশ। এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া হিসাব মান বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। আধুনিক প্রেক্ষাপটে, অ্যাকাউন্টিং বোর্ডের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ এটি নতুন প্রযুক্তি এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করতে সক্ষম।
আরও জানতে:
- ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড (FASB)
- সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC)
- সাধারণভাবে গৃহীত হিসাব নীতি (GAAP)
- আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মান (IFRS)
- কর্পোরেট গভর্নেন্স
- বিনিয়োগ বিশ্লেষণ
- আর্থিক প্রতিবেদন
- হিসাব নিরীক্ষা
- ফিনটেক
- ব্লকচেইন
- ESG রিপোর্টিং
- সাইবার নিরাপত্তা
- রাজস্ব স্বীকৃতি
- লিজিং
- আর্থিক উপকরণ
- সম্পত্তি, প্ল্যান্ট ও সরঞ্জাম
- মূল্যায়ন
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- নগদ প্রবাহ বিবরণী
- আয় বিবরণী
- উদ্বৃত্ত পত্র
- খরচ বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
- মুভিং এভারেজ
- আরএসআই (RSI)
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
