অডিট টেস্টিং
অডিট টেস্টিং
ভূমিকা: অডিট টেস্টিং হলো কোনো ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা যাচাই করার একটি প্রক্রিয়া। এটি নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে একজন নিরীক্ষক বিভিন্ন কৌশল এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনের সঠিকতা ও নির্ভরযোগ্যতা মূল্যায়ন করেন। এই টেস্টিংয়ের মাধ্যমে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য এবং ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে পারেন।
অডিট টেস্টিংয়ের উদ্দেশ্য: অডিট টেস্টিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- আর্থিক বিবরণীর যথার্থতা যাচাই করা: প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীগুলো হিসাববিজ্ঞান নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং সেখানে কোনো ভুল বা অসঙ্গতি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা।
- অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা: প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা এবং সম্পদ সুরক্ষায় কার্যকর কিনা, তা মূল্যায়ন করা।
- ঝুঁকি চিহ্নিত করা: প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো মোকাবিলার জন্য সুপারিশ করা।
- নিয়মকানুন মেনে চলা: প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কর্তৃক আরোপিত নিয়মকানুন মেনে চলছে কিনা, তা নিশ্চিত করা।
- জালিয়াতি সনাক্তকরণ: আর্থিক বিবরণীতে কোনো জালিয়াতি বা অনিয়ম হয়েছে কিনা, তা খুঁজে বের করা।
অডিট টেস্টিংয়ের প্রকারভেদ: অডিট টেস্টিং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের আকার, জটিলতা এবং ঝুঁকির মাত্রার উপর নির্ভর করে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
১. সম্মতি পরীক্ষা (Compliance Testing): এই ধরনের পরীক্ষায় নিরীক্ষক দেখেন যে প্রতিষ্ঠান তার অভ্যন্তরীণ নীতি এবং আইনকানুন মেনে চলছে কিনা। এখানে লেনদেনগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে কিনা এবং অনুমোদনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কিনা, তা যাচাই করা হয়।
২. substantive পরীক্ষা: এই পরীক্ষায় নিরীক্ষক আর্থিক বিবরণীর সংখ্যাগুলো সরাসরি যাচাই করেন। এর মধ্যে রয়েছে লেনদেনগুলোর সত্যতা যাচাই করা, হিসাবের জের টানা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করা। substantive পরীক্ষা সাধারণত সম্মতি পরীক্ষার চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য।
৩. বিস্তারিত পরীক্ষা (Detailed Testing): এই পরীক্ষায় নিরীক্ষক প্রতিটি লেনদেন বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করেন। এটি সাধারণত উচ্চ ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলোতে করা হয়, যেখানে জালিয়াতির সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৪. নমুনা পরীক্ষা (Sampling Testing): এই পরীক্ষায় নিরীক্ষক লেনদেনের একটি নমুনা নির্বাচন করে এবং তার ভিত্তিতে পুরো হিসাবের নির্ভুলতা মূল্যায়ন করেন। নমুনা পরীক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে ব্যবহার করা হয়।
অডিট টেস্টিংয়ের পদ্ধতি: অডিট টেস্টিংয়ের জন্য নিরীক্ষকরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
- পুনরায় নিশ্চিতকরণ (Confirmation): তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হিসাবের সত্যতা যাচাই করা। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক থেকে ব্যাংক ব্যালেন্সের তথ্য সংগ্রহ করা।
- পর্যবেক্ষণ (Observation): প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো কিভাবে কাজ করে, তা মূল্যায়ন করা।
- নথি পর্যালোচনা (Document Review): বিভিন্ন নথি, যেমন - চালান, চুক্তিপত্র, এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে লেনদেনের প্রমাণ সংগ্রহ করা।
- বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি (Analytical Procedures): আর্থিক তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিক প্রবণতা বা অসঙ্গতি খুঁজে বের করা। যেমন, আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণ।
- সাক্ষাৎকার (Interview): প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং ব্যবস্থাপনার সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের মতামত জানা।
- কম্পিউটার-সহায়ক অডিট কৌশল (CAAT): কম্পিউটার ব্যবহার করে বৃহৎ পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করা এবং অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিত করা।
ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং অডিট প্রোগ্রাম: অডিট টেস্টিং শুরু করার আগে নিরীক্ষককে ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হয়। ঝুঁকি মূল্যায়ন হলো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা এবং সেই ভুলের গুরুত্ব নির্ধারণ করা। ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী নিরীক্ষক একটি অডিট প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যেখানে পরীক্ষার scope, পদ্ধতি এবং সময়সীমা উল্লেখ করা থাকে।
| ঝুঁকি ক্ষেত্র | ঝুঁকির কারণ | নিরীক্ষণের পদ্ধতি | |||||||||||||
|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
| রাজস্ব স্বীকৃতি | জটিল চুক্তি, ভুল চালান | চুক্তি পর্যালোচনা, চালান যাচাই | মজুত | চুরি, obsolescence | শারীরিক গণনা, মূল্যায়ণ পরীক্ষা | দেনা | ভুল হিসাব, গোপন ঋণ | নিশ্চিতকরণ, চুক্তি পর্যালোচনা | স্থায়ী সম্পদ | ভুল অবচয়, মূল্যায়ন ত্রুটি | শারীরিক পরিদর্শন, হিসাব যাচাই |
অডিট টেস্টিংয়ের সময় বিবেচ্য বিষয়: অডিট টেস্টিংয়ের সময় নিরীক্ষককে কিছু বিষয় মনে রাখতে হয়:
- বস্তুনিষ্ঠতা (Objectivity): নিরীক্ষককে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কাজ করতে হবে।
- পেশাদারিত্ব (Professionalism): নিরীক্ষককে পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করতে হবে এবং গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।
- সন্দেহপূর্ণ মনোভাব (Professional Skepticism): নিরীক্ষককে সবসময় সন্দেহপূর্ণ মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে এবং সবকিছু যাচাই করতে হবে।
- পর্যাপ্ত প্রমাণ (Sufficient Appropriate Audit Evidence): নিরীক্ষককে পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে, যা তার মতামতের সমর্থনে কাজ করবে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ: অডিট টেস্টিংয়ের সময় টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনের অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করা যায়। টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ অতীতের ডেটা ব্যবহার করে ভবিষ্যতের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা জালিয়াতি সনাক্তকরণে সাহায্য করতে পারে। ভলিউম বিশ্লেষণ লেনদেনের পরিমাণ এবং ফ্রিকোয়েন্সি পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কার্যক্রম চিহ্নিত করতে পারে।
- চার্ট এবং গ্রাফ ব্যবহার করে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন করা।
- ট্রেন্ড লাইন এবং প্যাটার্ন সনাক্ত করা।
- ভলিউম স্পাইক এবং অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিত করা।
অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মূল্যায়ন: প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অডিট টেস্টিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিরীক্ষক নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মূল্যায়ন করেন:
- কর্তব্য বিভাজন (Segregation of Duties): কাজের দায়িত্বগুলো এমনভাবে ভাগ করা হয়েছে কিনা, যাতে কোনো একক ব্যক্তি জালিয়াতি করতে না পারে।
- অনুমোদন প্রক্রিয়া (Approval Process): লেনদেনগুলো সঠিকভাবে অনুমোদিত হচ্ছে কিনা।
- সম্পদ সুরক্ষা (Asset Protection): প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সঠিকভাবে সুরক্ষিত আছে কিনা।
- নথিভুক্তকরণ (Documentation): লেনদেনগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হচ্ছে কিনা।
- নিরীক্ষণ পথ (Audit Trail): লেনদেনগুলোর একটি সুস্পষ্ট নিরীক্ষণ পথ আছে কিনা, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করা যায়।
অডিট সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি: বর্তমানে অডিট টেস্টিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের অডিট সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি उपलब्ध রয়েছে। এই সফটওয়্যারগুলো ডেটা বিশ্লেষণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করে। কিছু জনপ্রিয় অডিট সফটওয়্যার হলো:
- ACL (Audit Command Language)
- IDEA (Interactive Data Extraction and Analysis)
- TeamMate
- CaseWare
এই প্রযুক্তিগুলো নিরীক্ষকদের কাজকে আরও সহজ ও নির্ভুল করে তোলে।
ফাইনাল রিপোটিং: অডিট টেস্টিং সম্পন্ন হওয়ার পর নিরীক্ষক একটি অডিট রিপোর্ট তৈরি করেন। এই রিপোর্টে নিরীক্ষক তার মতামত প্রকাশ করেন যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে কিনা। রিপোর্টে কোনো দুর্বলতা বা ঝুঁকি চিহ্নিত করা হলে, সে সম্পর্কে সুপারিশও করা হয়।
উপসংহার: অডিট টেস্টিং একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়ক। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং ঝুঁকি মূল্যায়ন করে নিরীক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে পারেন।
আরও জানতে:
- হিসাববিজ্ঞান নীতিমালা
- আর্থিক নিরীক্ষা
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ
- নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা
- জালিয়াতি সনাক্তকরণ
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- আর্থিক অনুপাত
- অডিট সফটওয়্যার
- অডিট রিপোর্ট
- হিসাবনিরীক্ষণ মান
- নমুনায়ন পদ্ধতি
- বস্তুনিষ্ঠতা
- পেশাদারিত্ব
- সন্দেহপূর্ণ মনোভাব
- পর্যাপ্ত প্রমাণ
- লেনদেন
- আইন
- নিরীক্ষণ
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
