David Ricardo
ডেভিড রিকার্ডো
ডেভিড রিকার্ডো (১৮ এপ্রিল ১৭৭২ – ১১ সেপ্টেম্বর ১৮২৩) ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ, যিনি ধ্রুপদী অর্থনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন ধারণা নিয়ে এসে অর্থনীতিকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রিকার্ডোর কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তুলনামূলক সুবিধার তত্ত্ব, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ভিত্তি স্থাপন করে।
প্রাথমিক জীবন ও কর্মজীবন
ডেভিড রিকার্ডো ১৭৭২ সালে লন্ডনে একটি ধনী ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ডাচ স্টকব্রোকার যিনি ইংল্যান্ডে সফলভাবে ব্যবসা করেন। রিকার্ডো প্রথমে বাবার ব্যবসায় যোগ দেন এবং অল্প বয়সেই স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। রিকার্ডোর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না, তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনা করে অর্থনীতি, রসায়ন, এবং অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
রিকার্ডো ১৮০৮ সালে জন স্টুয়ার্ট মিলের সাথে পরিচিত হন, যিনি পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মিলের সাথে তার বন্ধুত্ব রিকার্ডোর চিন্তাভাবনাকে আরও শাণিত করে এবং অর্থনীতি নিয়ে গভীর আলোচনা ও গবেষণায় উৎসাহিত করে। রিকার্ডো ১৮২৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অর্থনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্ব
রিকার্ডোর অর্থনৈতিক চিন্তা অ্যাডাম স্মিথ এবং থমাস মালথাস-এর কাজের দ্বারা প্রভাবিত ছিল, তবে তিনি তাদের অনেক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তার প্রধান অর্থনৈতিক অবদানগুলো হলো:
- তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব: রিকার্ডোর সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান হলো তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশের উচিত সেই পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি করা, যা তারা অন্য দেশের তুলনায় কম সুযোগ খরচে উৎপাদন করতে পারে। এর ফলে উভয় দেশই লাভবান হবে। এই তত্ত্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
- শ্রমের মূল্য তত্ত্ব: রিকার্ডো মনে করতেন, কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনে ব্যবহৃত শ্রমের পরিমাণের দ্বারা। তিনি মূল্য তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং বলেন যে, ভাড়া এবং মুনাফা শ্রমের মজুরি থেকে উদ্ভূত হয়।
- ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি: রিকার্ডো এই ধারণার প্রবর্তন করেন যে, অতিরিক্ত শ্রম বা মূলধন বিনিয়োগের ফলে উৎপাদনের বৃদ্ধি প্রথমে বাড়তে থাকে, কিন্তু একটা সময় পর তা কমতে থাকে।
- বিতরণের তত্ত্ব: রিকার্ডো আয় বিতরণ নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, ভূমি মালিক, শ্রমিক এবং পুঁজিবাদী - এই তিনটি শ্রেণীর মধ্যে জাতীয় আয় বণ্টিত হয়।
- মুদ্রার তত্ত্ব: রিকার্ডো মুদ্রার পরিমাণ তত্ত্বের ওপর জোর দেন এবং বলেন, মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
মূল্য তত্ত্ব
রিকার্ডোর মূল্য তত্ত্ব শ্রমের মূল্য তত্ত্ব এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি মনে করতেন, কোনো পণ্যের প্রকৃত মূল্য তার উৎপাদনে ব্যবহৃত শ্রমের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। রিকার্ডো দুটি ধরনের শ্রমের মধ্যে পার্থক্য করেন:
১. অবিচ্ছেদ্য শ্রম (Unskilled Labour): এই শ্রম সাধারণভাবে পরিমাপ করা যায়। ২. দক্ষ শ্রম (Skilled Labour): এই শ্রম পরিমাপ করা কঠিন, কারণ এটি অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের উপর নির্ভরশীল।
রিকার্ডো বলেন, দক্ষ শ্রমের মূল্য অবিচ্ছেদ্য শ্রমের মূল্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব
রিকার্ডোর তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশের উচিত সেই পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করা, যা তারা অন্য দেশের তুলনায় কম সুযোগ খরচে উৎপাদন করতে পারে। সুযোগ খরচ হলো অন্য একটি পণ্য উৎপাদন থেকে বিরত থাকার ফলে যে সুবিধা হারানো যায়।
উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক, বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়ই চাল এবং বস্ত্র উৎপাদন করতে পারে। যদি বাংলাদেশ ১ ইউনিট চাল উৎপাদনে ১ ঘণ্টা এবং ১ ইউনিট বস্ত্র উৎপাদনে ২ ঘণ্টা সময় নেয়, এবং ভারত ১ ইউনিট চাল উৎপাদনে ২ ঘণ্টা এবং ১ ইউনিট বস্ত্র উৎপাদনে ১ ঘণ্টা সময় নেয়, তাহলে:
- বাংলাদেশে ১ ইউনিট চালের সুযোগ খরচ হলো ২ ইউনিট বস্ত্র।
- ভারতে ১ ইউনিট চালের সুযোগ খরচ হলো ১ ইউনিট বস্ত্র।
এই ক্ষেত্রে, ভারতের চাল উৎপাদনে তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে, কারণ তাদের সুযোগ খরচ কম। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বস্ত্র উৎপাদনে তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে, কারণ তাদের সুযোগ খরচ কম। তাই, উভয় দেশেরই উচিত নিজেদের তুলনামূলক সুবিধা অনুযায়ী উৎপাদন করে বাণিজ্য করা।
এই তত্ত্ব অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং বিশ্ব বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।
বিতরণের তত্ত্ব
রিকার্ডো জাতীয় আয় বিতরণের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন:
১. ভূমি মালিক: তারা ভাড়ার মাধ্যমে আয় করে। ২. শ্রমিক: তারা মজুরির মাধ্যমে আয় করে। ৩. পুঁজিবাদী: তারা মুনাফার মাধ্যমে আয় করে।
রিকার্ডো মনে করতেন, ভূমি মালিক এবং পুঁজিবাদী উভয়ই শ্রমিকদের শোষণ করে। তিনি শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবনা পেশ করেন।
অর্থনীতির উপর প্রভাব
ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক চিন্তা উনিশ শতকের অর্থনীতিবিদদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার তত্ত্বগুলো নব্য ধ্রুপদী অর্থনীতি (Neoclassical Economics) এবং মারక్సిস্ট অর্থনীতি (Marxist Economics)-এর ভিত্তি স্থাপন করে। রিকার্ডোর কাজ আধুনিক বাণিজ্য নীতি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির আলোচনায় আজও প্রাসঙ্গিক।
রিকার্ডোর কাজের সমালোচনা
রিকার্ডোর তত্ত্বগুলো কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে:
- শ্রমের মূল্য তত্ত্ব: অনেকে মনে করেন, রিকার্ডোর শ্রমের মূল্য তত্ত্ব বাস্তবসম্মত নয়, কারণ এটি চাহিদা এবং যোগানর প্রভাবকে উপেক্ষা করে।
- ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি: এই বিধিটি সবসময় প্রযোজ্য নাও হতে পারে, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উন্নতির ক্ষেত্রে।
- বিতরণের তত্ত্ব: রিকার্ডোর বিতরণের তত্ত্ব শ্রমিকদের শোষণ সম্পর্কে একটি সরলীকৃত ধারণা দেয়।
গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলী
- Principles of Political Economy and Taxation (১৮১৭): এটি রিকার্ডোর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ, যেখানে তিনি তার অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
- On the Principles of Political Economy and Taxation (১৮২০)
- Notes on Malthus' Principles of Population (১৮২০)
উপসংহার
ডেভিড রিকার্ডো ছিলেন একজন প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ, যিনি অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব, শ্রমের মূল্য তত্ত্ব, এবং বিতরণের তত্ত্ব আজও অর্থনীতিবিদদের কাছে আলোচনার বিষয়। রিকার্ডোর কাজ অর্থনীতিকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে এবং আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে।
| তত্ত্ব | বিবরণ | প্রভাব |
| তুলনামূলক সুবিধা | কোন দেশ কোন পণ্য কম সুযোগ খরচে উৎপাদন করতে পারে, সেই অনুযায়ী বাণিজ্যের সুপারিশ | আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি নির্ধারণে সহায়ক |
| শ্রমের মূল্য তত্ত্ব | পণ্যের মূল্য উৎপাদনে ব্যবহৃত শ্রমের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল | মূল্য নির্ধারণের ধারণা প্রদান |
| ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি | অতিরিক্ত বিনিয়োগের ফলে উৎপাদনের বৃদ্ধি কমতে থাকে | উৎপাদন কৌশল নির্ধারণে সহায়ক |
| বিতরণের তত্ত্ব | জাতীয় আয় ভূমি মালিক, শ্রমিক ও পুঁজিবাদীর মধ্যে বণ্টিত হয় | আয় বৈষম্য নিয়ে আলোচনা |
এই নিবন্ধে ডেভিড রিকার্ডোর জীবন, কর্ম এবং অর্থনৈতিক চিন্তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
আরও জানতে: অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শ্রমের মূল্য তত্ত্ব, তুলনামূলক সুবিধা, রাজনৈতিক অর্থনীতি
সম্পর্কিত কৌশল, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণের জন্য লিঙ্ক:
- ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
- মুভিং এভারেজ
- আরএসআই (Relative Strength Index)
- এমএসিডি (Moving Average Convergence Divergence)
- ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট
- ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস (VWAP)
- বলিঙ্গার ব্যান্ডস
- স্টোকাস্টিক অসিলেটর
- ডাবল টপ এবং ডাবল বটম
- হেড অ্যান্ড শোল্ডারস প্যাটার্ন
- ট্রেন্ড লাইন
- সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল
- চার্ট প্যাটার্ন
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- অর্থনৈতিক সূচক
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
