পলিমার

পলিমার: গঠন, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহার

ভূমিকা পলিমার আধুনিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস, যেমন - প্লাস্টিক, রাবার, ফাইবার, রেজিন ইত্যাদি পলিমার দিয়ে তৈরি। পলিমার শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘পলি’ (বহু) এবং ‘মেরোস’ (অংশ) থেকে এসেছে, যার অর্থ অসংখ্য অংশ বা মনোমার দিয়ে গঠিত বৃহৎ অণু। এই নিবন্ধে পলিমারের গঠন, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার এবং পলিমার রসায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

পলিমারের সংজ্ঞা পলিমার হলো বৃহৎ আণবিক ওজনযুক্ত পদার্থ, যা অসংখ্য ছোট ছোট পুনরাবৃত্তিমূলক একক (মনোমার) দ্বারা গঠিত। এই মনোমারগুলি রাসায়নিক বন্ধন দ্বারা একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে দীর্ঘ শৃঙ্খল গঠন করে। পলিমার প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া যেতে পারে, যেমন – স্টার্চ, সেলুলোজ, প্রোটিন, অথবা কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষণ করা যেতে পারে, যেমন – পলিথিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি)।

পলিমারের গঠন পলিমারের গঠন মূলত মনোমারের প্রকার এবং তাদের সংযোগের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। পলিমার গঠনকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:

• রৈখিক পলিমার: এই পলিমারে মনোমারগুলি একটি সরল রেখার মতো যুক্ত থাকে। উদাহরণ: পলিথিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড।
• শাখা যুক্ত পলিমার: এই পলিমারে মূল শৃঙ্খলের সাথে বিভিন্ন দিকে শাখা যুক্ত থাকে। উদাহরণ: গ্লাইকোজেন।
• ক্রস-লিঙ্কড পলিমার: এই পলিমারে বিভিন্ন পলিমার শৃঙ্খল একে অপরের সাথে রাসায়নিক বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে, যা একটি ত্রিমাত্রিক জালিকা গঠন করে। উদাহরণ: রাবার, বেকলাইড।

পলিমারের প্রকারভেদ পলিমারকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:

• উৎসের ভিত্তিতে:

   * প্রাকৃতিক পলিমার: এই পলিমারগুলি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। যেমন – স্টার্চ, সেলুলোজ, প্রোটিন, প্রাকৃতিক রাবার ইত্যাদি। জৈব রসায়ন এদের উৎস অনুসন্ধানে সাহায্য করে।
   * কৃত্রিম পলিমার: এই পলিমারগুলি পরীক্ষাগারে বা শিল্প কারখানায় তৈরি করা হয়। যেমন – পলিথিন, পিভিসি, টেফলন, নাইলন ইত্যাদি।
   * অর্ধ-কৃত্রিম পলিমার: এই পলিমারগুলি প্রাকৃতিক পলিমারের রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। যেমন – সেলুলোজ অ্যাসিটেট।

• মনোমারের ভিত্তিতে:

   * হোমো পলিমার: এই পলিমার একটি মাত্র মনোমার দিয়ে গঠিত। যেমন – পলিথিন (ইথিলিন মনোমার দিয়ে গঠিত)।
   * কোপলিমার: এই পলিমার দুই বা ততোধিক ভিন্ন মনোমার দিয়ে গঠিত। যেমন – বা Buna-S রাবার (বিউটাডিন ও স্টাইরিন মনোমার দিয়ে গঠিত)।

• তাপীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে:

   * থার্মোপ্লাস্টিক: এই পলিমারগুলিকে উত্তপ্ত করলে নরম হয়ে যায় এবং ঠান্ডা করলে আবার কঠিন হয়। এই প্রক্রিয়া একাধিকবার করা যায়। উদাহরণ: পলিথিন, পিভিসি। তাপগতিবিদ্যা এই পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে।
   * থার্মোসেটিং পলিমার: এই পলিমারগুলিকে উত্তপ্ত করলে প্রথমে নরম হয়, কিন্তু পুনরায় ঠান্ডা করলে কঠিন হয়ে যায় এবং এরপর উত্তপ্ত করলে আর নরম হয় না। উদাহরণ: বেকলাইড, ইপোক্সি রেজিন।

পলিমারের বৈশিষ্ট্য পলিমারের বৈশিষ্ট্য তাদের গঠন, রাসায়নিক বন্ধন এবং আণবিক ওজনের উপর নির্ভর করে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:

• আণবিক ওজন: পলিমারের আণবিক ওজন অনেক বেশি হয়ে থাকে, যা তাদের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে।
• গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক: পলিমারের গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক তাদের আণবিক ওজন এবং আন্তঃআণবিক বলের উপর নির্ভর করে।
• দৃঢ়তা ও নমনীয়তা: পলিমারের গঠন এবং আন্তঃআণবিক বলের কারণে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার দৃঢ়তা ও নমনীয়তা দেখা যায়।
• দ্রবণীয়তা: পলিমারগুলি সাধারণত জৈব দ্রাবকে দ্রবণীয় হয়, তবে কিছু পলিমার পানিতেও দ্রবণীয় হতে পারে।
• রাসায়নিক স্থিতিশীলতা: পলিমারগুলি সাধারণত রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল হয়, তবে কিছু পলিমার নির্দিষ্ট রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে।
• বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য: কিছু পলিমার বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়, আবার কিছু পলিমার অন্তরক হিসাবে কাজ করে। কন্ডাক্টিং পলিমার এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পলিমারের ব্যবহার পলিমারের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে আধুনিক জীবনে এর গুরুত্ব অপরিহার্য। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:

• প্লাস্টিক শিল্প: পলিমার প্লাস্টিক শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পলিথিন, পিভিসি, পলিপ্রোপিলিন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
• রাবার শিল্প: প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম রাবার উভয়ই পলিমার। টায়ার, টিউব, রাবার ব্যান্ড, খেলনা ইত্যাদি তৈরিতে রাবার ব্যবহৃত হয়।
• ফাইবার শিল্প: পলিমার ফাইবার শিল্পে বস্ত্র, দড়ি, জাল, কার্পেট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। নাইলন, পলিয়েস্টার, অ্যাক্রিলিক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পলিমার ফাইবার।
• চিকিৎসা বিজ্ঞান: পলিমার চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়, যেমন – ঔষধের আবরণ, সার্জিক্যাল সুতা, কৃত্রিম অঙ্গ, এবং ঔষধ সরবরাহ করার জন্য পলিমারিক ন্যানো পার্টিকেল। বায়োমেটেরিয়াল এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
• প্যাকেজিং শিল্প: পলিমার খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য পণ্য প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা পণ্যকে দূষণ থেকে রক্ষা করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।
• নির্মাণ শিল্প: পলিমার নির্মাণ শিল্পে পাইপ, জানালা, দরজা, এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
• পরিবহন শিল্প: পলিমার পরিবহন শিল্পে গাড়ির বিভিন্ন অংশ, যেমন – বাম্পার, ড্যাশবোর্ড, এবং ইন্টেরিয়র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা গাড়ির ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং জ্বালানি সাশ্রয় করে।
• ইলেকট্রনিক্স শিল্প: পলিমার ইলেকট্রনিক্স শিল্পে অন্তরক হিসাবে এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক উপাদান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

গুরুত্বপূর্ণ পলিমার এবং তাদের ব্যবহার

| পলিমারের নাম | মনোমার | ব্যবহার | |---|---|---| | পলিথিন | ইথিলিন | প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল, ফিল্ম তৈরি | | পিভিসি | ভিনাইল ক্লোরাইড | পাইপ, জানালা, তারের আবরণ | | পলিপ্রোপিলিন | প্রোপিলিন | প্যাকেজিং, অটোমোটিভ যন্ত্রাংশ | | পলিস্টাইরিন | স্টাইরিন | ফোম, প্যাকেজিং, ডিসপোজেবল পাত্র | | টেফলন | টেট্রাফ্লুরোইথিলিন | নন-স্টিক কোটিং, সিল, গ্যাসকেট | | নাইলন | হেক্সামেথিলিন ডায়ামিন ও অ্যাডিপিক অ্যাসিড | বস্ত্র, দড়ি, ব্রাশ | | পলিয়েস্টার | ইথিলিন গ্লাইকল ও টেরেফথ্যালিক অ্যাসিড | বস্ত্র, বোতল, ফিল্ম | | বাকেলাইট | ফেনল ও ফর্মালডিহাইড | বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, হ্যান্ডেল | | সিলিকন | ডাইমিথাইলসিলোক্সেন | লুব্রিকেন্ট, সিলান্ট, মেডিকেল ইমপ্লান্ট | | পলিউরেথেন | ডাইআইসোসায়ানেট ও পলিওল | ফোম, আবরণ, আঠা |

পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়া পলিমারাইজেশন হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ছোট ছোট মনোমার যুক্ত হয়ে বৃহৎ পলিমার অণু গঠন করে। পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়াকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

• সংযোজন পলিমারাইজেশন: এই প্রক্রিয়ায় মনোমারগুলি সরাসরি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে পলিমার গঠন করে। এক্ষেত্রে কোনো ছোট অণু উপজাত হিসাবে তৈরি হয় না। উদাহরণ: পলিথিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড।
• ঘনীভবন পলিমারাইজেশন: এই প্রক্রিয়ায় মনোমারগুলি যুক্ত হওয়ার সময় ছোট অণু, যেমন – পানি, অ্যালকোহল, বা অ্যামোনিয়া উপজাত হিসাবে নির্গত হয়। উদাহরণ: পলিয়েস্টার, নাইলন। রাসায়নিক বিক্রিয়া এই প্রক্রিয়াগুলোর গতি ও ধরণ ব্যাখ্যা করে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা পলিমার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে। বর্তমানে, বিজ্ঞানীরা পরিবেশ-বান্ধব পলিমার, যেমন – বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার (biodegradable polymer) এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলিমার (recyclable polymer) তৈরির উপর জোর দিচ্ছেন। এছাড়াও, ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পলিমার তৈরির গবেষণা চলছে, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। স্মার্ট পলিমার, সেলফ-হিলিং পলিমার এবং কন্ডাক্টিং পলিমারের মতো নতুন ধরনের পলিমার উদ্ভাবনের মাধ্যমে পলিমার বিজ্ঞান আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

উপসংহার পলিমার আমাদের আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর গঠন, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলিমার বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নয়ন নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে আরও উন্নত করতে সহায়ক হবে।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ