যক্ষগণ
যক্ষগণ
যক্ষগণ পৌরাণিক কাহিনী ও লোককথার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা সাধারণত প্রকৃতি ও সম্পদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে যক্ষদের সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে, তবে তাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো প্রায় একই থাকে। এই নিবন্ধে যক্ষদেরOrigin, বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, বাসস্থান, ক্ষমতা, মানুষের সাথে সম্পর্ক এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Origin ও ইতিহাস
যক্ষদেরOrigin সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, তবে ধারণা করা হয় যে তারা বৈদিক সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। বেদ ও উপনিষদ-এ যক্ষদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তারা দেবতাগণের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। পরবর্তীকালে, পুরাণ ও তন্ত্র-এ যক্ষদের আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে করা হয়, যক্ষ শব্দটি ‘যাচ্ছ’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘আবেদন করা’ বা ‘طلب করা’। অর্থাৎ, যক্ষরা হলেন তারা, যারা দেবতাদের কাছে মানুষের আবেদন পৌঁছে দেন।
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতিতেও যক্ষদের অনুরূপ কিছু সত্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন নিম্ফ ও স্যাটার। তবে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে যক্ষদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বৈশিষ্ট্য
যক্ষগণ সাধারণত মানবসদৃশ বা পশুসদৃশ রূপে দেখা যায়। তাদের শারীরিক গঠন শক্তিশালী ও সুন্দর হয়। যক্ষদের চামড়ার রং বিভিন্ন হতে পারে, যেমন – উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ণ, সবুজ, নীল বা সাদা। তাদের চোখ খুব উজ্জ্বল হয় এবং রাতে অন্ধকারেও দেখতে পায়। যক্ষদের মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান:
- দীর্ঘ জীবন: যক্ষরা দীর্ঘজীবী হয় এবং কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
- অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা: তারা নিজেদের ইচ্ছামতো অদৃশ্য হতে পারে।
- স্থানান্তর ক্ষমতা: যক্ষরা খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে।
- রূপ পরিবর্তন: তারা নিজেদের রূপ পরিবর্তন করতে সক্ষম।
- সম্পদ ও ধন-সম্পদের প্রতি আকর্ষণ: যক্ষরা সাধারণত ধন-সম্পদ ভালোবাসে এবং তা রক্ষা করে।
প্রকারভেদ
যক্ষদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। তাদের কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- সিদ্ধ যক্ষ: এরা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন।
- গন্ধর্ব্ব যক্ষ: এরা সঙ্গীত ও নৃত্যে পারদর্শী এবং স্বর্গের অপ্সরাদের সাথে বাস করে।
- নাগ যক্ষ: এরা সাপের মতো দেখতে এবং জলের নিচে বাস করে।
- বিমানযক্ষ: এরা আকাশে বিচরণ করে এবং দ্রুত গতিতে ভ্রমণ করতে পারে।
- ভূযক্ষ: এরা পৃথিবীর নিচে বাস করে এবং খনিজ সম্পদ রক্ষা করে।
- বনযক্ষ: এরা বনে বাস করে এবং পশু-পাখিদের রক্ষা করে।
| প্রকার | বৈশিষ্ট্য | বাসস্থান | |||||||||||||||||||||
| সিদ্ধ যক্ষ | অত্যন্ত শক্তিশালী, অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন | স্বর্গ, মর্ত্যলোক | গন্ধর্ব্ব যক্ষ | সঙ্গীত ও নৃত্যে পারদর্শী | স্বর্গ, মর্ত্যলোক | নাগ যক্ষ | সাপের মতো দেখতে | জলের নিচে | বিমানযক্ষ | আকাশে বিচরণকারী, দ্রুতগামী | আকাশ | ভূযক্ষ | পৃথিবীর নিচে বাসকারী | পৃথিবীর অভ্যন্তর | বনযক্ষ | পশু-পাখি রক্ষাকারী | বন |
বাসস্থান
যক্ষদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান নেই। তারা বিভিন্ন স্থানে বাস করতে পারে। কিছু যক্ষ স্বর্গলোকে বাস করে, আবার কিছু মর্ত্যলোকে। তারা বন, পর্বত, নদী, সমুদ্র, এবং এমনকি মানুষের বসতির আশেপাশেও বাস করে। যক্ষরা সাধারণত এমন স্থানে বাস করতে পছন্দ করে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং যেখানে ধন-সম্পদ বিদ্যমান।
বিশেষ করে, তারা প্রাচীন মন্দির, স্তূপ, গির্জা, পাহাড়, বন, নদী, লেক, ঝর্ণা এবং গুহা ইত্যাদিতে বাস করে বলে মনে করা হয়।
ক্ষমতা
যক্ষদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। তাদের কিছু প্রধান ক্ষমতা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- অলৌকিক শক্তি: যক্ষরা তাদের অলৌকিক শক্তি দিয়ে অনেক কঠিন কাজ সহজে করতে পারে।
- ধন-সম্পদ সৃষ্টি: তারা ধন-সম্পদ সৃষ্টি করতে এবং তা রক্ষা করতে পারে।
- রোগ নিরাময়: যক্ষরা বিভিন্ন রোগের নিরাময় করতে সক্ষম।
- বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ: তারা বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ফসলের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
- ভবিষ্যৎ দর্শন: কিছু যক্ষ ভবিষ্যৎ দেখতে পারে এবং মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
- মন্ত্র ও তন্ত্র: যক্ষরা মন্ত্র ও তন্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করতে পারে।
মানুষের সাথে সম্পর্ক
যক্ষদের সাথে মানুষের সম্পর্ক জটিল। কিছু যক্ষ মানুষের বন্ধু এবং সহায়ক, আবার কিছু যক্ষ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সাধারণভাবে, যক্ষরা মানুষের প্রতি নিরপেক্ষ থাকে, তবে তারা তাদের বাসস্থান ও সম্পদের প্রতি খুব সংবেদনশীল।
যদি কোনো মানুষ যক্ষদের সম্মান করে এবং তাদের পরিবেশের ক্ষতি না করে, তবে যক্ষরা তাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু, যদি কেউ যক্ষদের অসন্তুষ্ট করে, তবে তারা তাকে শাস্তি দিতে পারে। ইতিহাস ও লোককথা-য় যক্ষদের দ্বারা মানুষ উপকৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
যক্ষদের সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের পূজা ও অর্চনা করে থাকে। গ্রাম্য সমাজে যক্ষপূজা একটি প্রচলিত রীতি।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যক্ষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যক্ষদের নিয়ে অনেক গল্প ও কবিতা রচিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর মেঘনাদ বধ কাব্যে যক্ষদের সুন্দর ও রহস্যময় রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর গল্প ও কবিতায়ও যক্ষদের প্রসঙ্গ এসেছে।
এছাড়াও, লালন শাহ-এর বাউল গানে যক্ষদের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে যক্ষদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
লোকনাটক, যক্ষগণ, পালাগান ও জনশ্রুতি-তে যক্ষদের চরিত্র প্রায়শই দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ-এর অনেক গ্রামে যক্ষপূজা আজও প্রচলিত আছে।
যক্ষ ও অন্যান্য সত্তা
যক্ষদের প্রায়শই অন্যান্য পৌরাণিক সত্তার সাথে তুলনা করা হয়। যেমন:
- পরী: পরীরাও যক্ষদের মতো অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন, তবে তারা সাধারণত আরও দয়ালু এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল।
- ভূতে: ভূত-প্রেতরা সাধারণত মৃত মানুষের আত্মা, যারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। যক্ষরা জীবিত সত্তা এবং তাদের নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে।
- দৈত্য: দৈত্যরা সাধারণত শক্তিশালী ও রাক্ষুসে হয় এবং মানুষের ক্ষতি করতে পছন্দ করে। যক্ষরা সাধারণত নিরপেক্ষ এবং তারা মানুষের ক্ষতি করে না, যতক্ষণ না তাদের উত্যক্ত করা হয়।
- অশরীরী: অশরীরী বলতে এমন সত্তাকে বোঝায় যার শরীর নেই। যক্ষরাও অশরীরী হতে পারে, তবে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো রূপ ধারণ করতে পারে।
| সত্তা | বৈশিষ্ট্য | ||||||||||
| পরী | দয়ালু, সহানুভূতিশীল, অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন | ভূত | মৃত মানুষের আত্মা, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় | দৈত্য | শক্তিশালী, রাক্ষুসে, মানুষের ক্ষতি করতে পছন্দ করে | অশরীরী | শরীরবিহীন সত্তা |
আধুনিক যুগে যক্ষদের ধারণা
আধুনিক যুগে যক্ষদের ধারণা অনেকটা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরিবেশবাদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে যক্ষদের প্রতীকী ব্যবহার করা হয়। যক্ষদের প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে, মানুষ পরিবেশের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে উৎসাহিত হয়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যক্ষদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তবে তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
আরও দেখুন
- পৌরাণিক প্রাণী
- লোককথা
- বাংলা লোকসাহিত্য
- দেবতা
- অসুর
- গন্ধর্ব্ব
- নক্ষত্র
- জ্যোতিষশাস্ত্র
- তন্ত্র
- মন্ত্র
- পূজা
- অর্চনা
- মন্দির
- স্তূপ
- গির্জা
- গ্রাম্য সংস্কৃতি
- বাউল গান
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
