টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ইতিহাস

ভূমিকা

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস হলো আর্থিক বাজারের পূর্বাভাস দেওয়ার একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক মূল্য এবং ভলিউম ডেটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের বাজারের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করা হয়। বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এই বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ট্রেডারদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এই নিবন্ধে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস আলোচনা করা হবে।

সূচনা এবং প্রাথমিক পর্যায় (ঊনবিংশ শতাব্দী)

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ধারণাটি নতুন নয়। এর উৎস উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন ফিনান্সিয়াল মার্কেটগুলো আধুনিক রূপ নিতে শুরু করে। যদিও তখন এটিকে সুসংবদ্ধভাবে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস বলা হতো না, তবুও কিছু মৌলিক ধারণা প্রচলিত ছিল।

জোসেফ ডি লা পোম্প (Joseph de la Pompie): ফরাসি স্টক ব্রোকার জোসেফ ডি লা পোম্পকে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৬১ সালে তিনি "মেমোয়ার অন দ্য মুভমেন্টস অফ দ্য স্টক মার্কেট" (Mémoire sur les mouvements du marché des valeurs) নামক একটি বই লেখেন। এই বইয়ে তিনি বাজারের গতিবিধি চক্রাকারে হয় এবং অতীতের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে, এমন ধারণা দেন। তিনি বাজারের গড় মূল্য এবং প্রবণতা (trend) অনুসরণ করার কথা বলেন।

চার্লস ডাউ (Charles Dow): টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের জনক হিসেবে পরিচিত চার্লস ডাউ ছিলেন একজন আমেরিকান সাংবাদিক এবং বিনিয়োগকারী। তিনি ১৮৮০-এর দশকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে (Wall Street Journal) কাজ করতেন এবং বাজারের গতিবিধি নিয়ে নিয়মিত লিখতেন। ডাউ থিওরি (Dow Theory) নামে তার দেওয়া তত্ত্ব টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ভিত্তি স্থাপন করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বাজারের তিনটি প্রধান প্রকারভেদ রয়েছে: প্রাথমিক প্রবণতা (primary trend), মাধ্যমিক প্রবণতা (secondary trend) এবং গৌণ প্রবণতা (minor trend)। ডাউ বিশ্বাস করতেন যে বাজারের গড় মূল্য (average price) বাজারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। ডাউ থিওরি আজও অনেক ট্রেডার অনুসরণ করেন।

ডাউ থিওরির মূল ধারণা:

বাজার সবকিছুDiscount করে: বাজারের মূল্য অতীতের, বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের সমস্ত তথ্য প্রতিফলিত করে।
তিন ধরনের প্রবণতা: প্রাথমিক (দীর্ঘমেয়াদী), মাধ্যমিক (মাঝমেয়াদী) এবং গৌণ (স্বল্পমেয়াদী)।
গড়গুলি নিশ্চিতকরণ প্রদান করে: মূল প্রবণতা পরিবর্তনের সময় গড়গুলি নিশ্চিতকরণ সংকেত দেয়।
ভলিউম প্রবণতা নিশ্চিত করে: মূল্য পরিবর্তনের সাথে ভলিউম বৃদ্ধি প্রবণতাকে শক্তিশালী করে।

প্রথম দিকের সরঞ্জাম এবং পদ্ধতি

এই সময়কালে, টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টরা কিছু প্রাথমিক সরঞ্জাম এবং পদ্ধতি ব্যবহার করতেন:

চার্ট তৈরি: বাজারের দামের গতিবিধি বোঝার জন্য হাতে কলমে চার্ট তৈরি করা হতো।
গড় মূল্য: ঐতিহাসিক দামের গড় হিসাব করে বাজারের প্রবণতা নির্ণয় করা হতো।
সমর্থন এবং প্রতিরোধ স্তর: Support and Resistance Level চিহ্নিত করে সম্ভাব্য মূল্য পরিবর্তনের স্থানগুলো অনুমান করা হতো।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের বিকাশ (বিংশ শতাব্দী)

বিংশ শতাব্দীতে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস আরও উন্নত ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। নতুন নতুন সরঞ্জাম এবং কৌশল উদ্ভাবিত হয়, যা ট্রেডারদের জন্য আরও কার্যকর প্রমাণ করে।

জন ওয়ারেন (John Warren): ১৯৩০-এর দশকে জন ওয়ারেন টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন, যার নাম "দ্য মার্কেট মেকানিক্স" (The Market Mechanics)। তিনি বাজারের মনস্তত্ত্ব এবং বিনিয়োগকারীদের আচরণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

রিচার্ড ওয়াইলি (Richard Wylie): রিচার্ড ওয়াইলি ১৯৪০-এর দশকে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ওপর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তিনি চার্ট প্যাটার্ন এবং ট্রেন্ড লাইন ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

রবার্ট কিয়োসাঙ্কি (Robert Kiyosaki): রবার্ট কিয়োসাঙ্কি একজন বিখ্যাত বিনিয়োগকারী এবং লেখক। তিনি টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস এবং আর্থিক শিক্ষার ওপর বেশ কিছু প্রভাবশালী বই লিখেছেন। রবার্ট কিয়োসাঙ্কি-র কাজ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

নতুন সরঞ্জাম এবং সূচক

এই সময়কালে বেশ কিছু নতুন টেকনিক্যাল সূচক উদ্ভাবিত হয়:

মুভিং এভারেজ (Moving Average): এটি একটি জনপ্রিয় সূচক, যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দামের গড় হিসাব করে বাজারের প্রবণতা নির্ণয় করতে সাহায্য করে। মুভিং এভারেজ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন সিম্পল মুভিং এভারেজ (SMA) এবং এক্সপোনেনশিয়াল মুভিং এভারেজ (EMA)।

রিলেটিভ স্ট্রেন্থ ইন্ডেক্স (RSI): এটি একটি মোমেন্টাম সূচক, যা দামের পরিবর্তন দেখে বাজারের অতিরিক্ত কেনা বা অতিরিক্ত বিক্রির অবস্থা নির্ণয় করে। RSI সাধারণত ০ থেকে ১০০ এর মধ্যে থাকে।

MACD (Moving Average Convergence Divergence): এটি দুটি মুভিং এভারেজের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করে বাজারের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দেয়। MACD একটি বহুল ব্যবহৃত সূচক।

ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট (Fibonacci Retracement): এই কৌশলটি ফিবোনাচ্চি অনুপাত ব্যবহার করে সম্ভাব্য সমর্থন এবং প্রতিরোধ স্তরগুলো চিহ্নিত করে। ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট ট্রেডারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কম্পিউটার এবং টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস (বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ)

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কম্পিউটারের ব্যবহার টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসে বিপ্লব আনে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে চার্ট তৈরি এবং ডেটা বিশ্লেষণ করা সহজ হয়ে যায়।

চার্টিং সফটওয়্যার: বিভিন্ন চার্টিং সফটওয়্যার, যেমন MetaTrader, TradingView ইত্যাদি বাজারে আসে, যা রিয়েল-টাইম ডেটা এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল সূচক ব্যবহারের সুবিধা দেয়।

অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং: কম্পিউটারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেড করার জন্য অ্যালগরিদম তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে, পূর্বনির্ধারিত নিয়ম এবং শর্তের ভিত্তিতে ট্রেড করা হয়। অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়।

ব্যাকটেস্টিং (Backtesting): ঐতিহাসিক ডেটা ব্যবহার করে ট্রেডিং কৌশল পরীক্ষা করার পদ্ধতি হলো ব্যাকটেস্টিং। এর মাধ্যমে কোনো কৌশল কতটা কার্যকর, তা যাচাই করা যায়।

আধুনিক টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস (একবিংশ শতাব্দী)

একবিংশ শতাব্দীতে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস আরও অত্যাধুনিক হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির ব্যবহার এটিকে আরও কার্যকর করে তুলেছে।

বিগ ডেটা এবং মেশিন লার্নিং: বিগ ডেটা এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বাজারের জটিল প্যাটার্নগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

Sentiment Analysis: সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহ করে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব (sentiment) বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

উন্নত চার্টিং কৌশল: Renko chart, Heikin Ashi chart-এর মতো উন্নত চার্টিং কৌশলগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভলিউম স্প্রেড অ্যানালাইসিস (Volume Spread Analysis): এই পদ্ধতিতে ভলিউম এবং প্রাইসের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বাজারের গতিবিধি বোঝা যায়। ভলিউম স্প্রেড অ্যানালাইসিস একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।

বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের প্রয়োগ

বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু সাধারণ প্রয়োগ উল্লেখ করা হলো:

ট্রেন্ড চিহ্নিতকরণ: টেকনিক্যাল সূচক ব্যবহার করে বাজারের আপট্রেন্ড (uptrend) বা ডাউনট্রেন্ড (downtrend) চিহ্নিত করা যায়।
সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল: এই স্তরগুলো ব্যবহার করে সম্ভাব্য এন্ট্রি এবং এক্সিট পয়েন্ট নির্ধারণ করা যায়।
চার্ট প্যাটার্ন: বিভিন্ন চার্ট প্যাটার্ন, যেমন হেড অ্যান্ড শোল্ডারস (head and shoulders), ডাবল টপ (double top), ডাবল বটম (double bottom) ইত্যাদি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের মূল্য নির্ধারণ করা যায়।
মোমেন্টাম ইন্ডিকেটর: RSI, MACD-এর মতো সূচকগুলো ব্যবহার করে বাজারের গতিবিধি এবং অতিরিক্ত কেনা বা বিক্রির অবস্থা জানা যায়।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের সীমাবদ্ধতা

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নেই: টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস অতীতের ডেটার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দেয়, কিন্তু এটি ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
মিথ্যা সংকেত: অনেক সময় টেকনিক্যাল সূচকগুলো ভুল সংকেত দিতে পারে, যার ফলে ট্রেডাররা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বাজারের অপ্রত্যাশিত ঘটনা: রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঘটনার কারণে বাজারে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসতে পারে, যা টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে অনুমান করা কঠিন।

উপসংহার

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ইতিহাস দীর্ঘ এবং বিবর্তনশীল। জোসেফ ডি লা পোম্প এবং চার্লস ডাউ-এর প্রাথমিক কাজ থেকে শুরু করে আধুনিক বিগ ডেটা এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম পর্যন্ত, এই পদ্ধতিটি ক্রমাগত উন্নত হয়েছে। বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস একটি অপরিহার্য হাতিয়ার, যা ট্রেডারদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তবে, এর সীমাবদ্ধতাগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং অন্যান্য বিশ্লেষণের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করা উচিত।

আরও জানতে:

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ইতিহাস

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

Navigation menu