অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস
সূচনা
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস প্রায় ৬5,০০০ বছর আগে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের আগমন দিয়ে শুরু হয়। এরপর ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশদের উপনিবেশ স্থাপন পর্যন্ত এই অঞ্চলের ইতিহাস মূলত আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে ইউরোপীয় বসতি, স্বর্ণ অনুসন্ধান, দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের নানা ঘটনা ঘটেছে। এই নিবন্ধে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের ইতিহাস
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী মানুষেরা পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম। তারা প্রায় ৬5,০০০ বছর আগে ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসে বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ৩,০০০ বছর আগে তাসমানিয়াতেও তাদের বসতি ছিল। তারা ‘ড্রীমটাইম’ নামক একটি জটিল আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল, যা তাদের সংস্কৃতি, আইন এবং জীবনযাত্রার ভিত্তি স্থাপন করে।
- ভাষা: অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা প্রায় ২৫০টি ভিন্ন ভাষায় কথা বলত।
- জীবনযাপন: তারা শিকারী-সংগ্রাহক হিসেবে জীবনযাপন করত এবং প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল।
- শিল্পকলা: আদিবাসীরা গুহাচিত্র, বুমেরাং এবং অন্যান্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি প্রকাশ করত। কাকাদু জাতীয় উদ্যান-এর গুহাচিত্রগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
- সামাজিক কাঠামো: তাদের সমাজ ছিল গোষ্ঠীভিত্তিক এবং বয়স্ক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দিত।
ইউরোপীয় আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপন (১৭৮৮-১৯০০)
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইউরোপীয় আবিষ্কারক ছিলেন ডাচ নাবিক উইলিয়াম জ্যানসন যিনি ১৬০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার উপকূল আবিষ্কার করেন। তবে, জেমস কুক ১৭৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করেন। ১৮ জানুয়ারি ১৭৮৮ সালে আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে প্রথম নৌবহর সিডনিতে অবতরণ করে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা হয়। এই দিনটি অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে ‘ফাউন্ডেশন ডে’ হিসেবে পালিত হয়।
- প্রথম ফ্লিট: ১৭৮৮ সালে ১১টি জাহাজ নিয়ে গঠিত প্রথম নৌবহর অস্ট্রেলিয়ায় আসে, যাদের মধ্যে convicts (অপরাধী) ও marines (সৈনিক) ছিল।
- উপনিবেশের বিস্তার: সিডনি থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থানেও ব্রিটিশ বসতি বিস্তার লাভ করে, যেমন মেলবোর্ন, ব্রিসবেন এবং পার্থ।
- আদিবাসীদের উপর প্রভাব: ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের ফলে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের ভূমি ও জীবনযাত্রা হারাতে শুরু করে। তাদের মধ্যে রোগ, সংঘাত এবং সংস্কৃতি ধ্বংসের কারণে জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়।
- স্বর্ণ অনুসন্ধান: ১৮৫০-এর দশকে ভিক্টোরিয়াতে স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায়, যা অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি ও জনসংখ্যার দ্রুত পরিবর্তনে সহায়ক হয়। গোল্ড কোস্ট এই সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- পরিবহন নীতি: ব্রিটিশ সরকার অস্ট্রেলিয়াকে তাদের কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীদের নির্বাসনের স্থান হিসেবে।
ফেডারেশন ও জাতিরাষ্ট্রের জন্ম (১৯০১-১৯১৪)
উনিশ শতকের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশ একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯০১ সালের ১ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান কমনওয়েলথ গঠিত হয়, যা অস্ট্রেলিয়াকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ খুলে দেয়। এডমন্ড বার্টন ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
- ফেডারেশন সম্মেলন: ১৮৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি ফেডারেশন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশগুলোর নেতারা একত্রিত হয়ে একটি নতুন সংবিধান তৈরির বিষয়ে আলোচনা করেন।
- সংবিধান: ১৯০১ সালের অস্ট্রেলিয়ান সংবিধান গৃহীত হয়, যা একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে।
- রাজধানী: ক্যানবেরাকে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাজ্যের সাথে মিত্র হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। গ্যালিপলির যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের বীরত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আন্তঃযুদ্ধকালীন সময় ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৯-১৯৪৫)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ১৯২৯ সালের মহামন্দা অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া আবারও মিত্রশক্তির পক্ষে অংশগ্রহণ করে।
- অর্থনৈতিক সংকট: ১৯২৯ সালের মহামন্দার কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
- সামাজিক পরিবর্তন: নারীদের অধিকার এবং শ্রমিক আন্দোলনের বিস্তার ঘটে।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্ল হারবার আক্রমণের পর অস্ট্রেলিয়া বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
- যুদ্ধকালীন অর্থনীতি: যুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হতে শুরু করে এবং শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
যুদ্ধ-পরবর্তী অস্ট্রেলিয়া ও অভিবাসন (১৯৪৫-১৯৭৫)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়া দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন লাভ করে। অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করা হয় এবং বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীদের আগমন ঘটে।
- অভিবাসন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়া ‘হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া’ নীতি থেকে সরে এসে অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে। ইতালীয় এবং গ্রিক অভিবাসীরা প্রচুর সংখ্যায় অস্ট্রেলিয়ায় আসে।
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে খনিজ সম্পদ এবং কৃষিখাতে।
- সামাজিক পরিবর্তন: টেলিভিশন এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রচলন সমাজে নতুনত্ব আনে।
- ভিয়েতনাম যুদ্ধ: ভিয়েতনাম যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়।
আধুনিক অস্ট্রেলিয়া (১৯৭৫-বর্তমান)
১৯৭৫ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া একটি আধুনিক, বহুজাতিক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, আদিবাসী অধিকারের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
- রাজনৈতিক সংস্কার: ১৯৭০-এর দশকে রাজনৈতিক সংস্কারের ফলে সরকারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়।
- আদিবাসী অধিকার: আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন জোরদার হয় এবং তাদের ভূমির অধিকার ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দাবিগুলো স্বীকৃতি পায়। ম্যাবো সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
- অর্থনৈতিক উদারীকরণ: ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। জাতিসংঘ এবং এপেক এর মতো সংস্থায় অস্ট্রেলিয়ার অবদান উল্লেখযোগ্য।
- বহুসংস্কৃতিবাদ: অস্ট্রেলিয়া একটি বহুসংস্কৃতির দেশ হিসেবে পরিচিত এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতির মানুষের সহাবস্থান এখানে বিদ্যমান।
অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি: একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র
অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি মূলত খনিজ সম্পদ, কৃষি এবং পরিষেবা খাতের উপর নির্ভরশীল।
| জিডিপিতে অবদান (২০২৩) | | প্রায় ১০% | | প্রায় ৩% | | প্রায় ৭৫% | | প্রায় ১২% | |
উপসংহার
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস বৈচিত্র্যময় এবং জটিল। আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ উপনিবেশ, ফেডারেশন, এবং আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ—সবই এই অঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক এবং বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে।
আরও দেখুন
- অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী
- অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশ
- অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন
- অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি
- অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি
- মেলবোর্ন
- সিডনি
- ক্যানবেরা
- ভিক্টোরিয়া (অস্ট্রেলিয়া)
- নিউ সাউথ ওয়েলস
- কুইন্সল্যান্ড
- পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া
- দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া
- তাসমানিয়া
- নর্দার্ন টেরিটরি
- গোল্ড কোস্ট
- কাকাদু জাতীয় উদ্যান
- জেমস কুক
- আর্থার ফিলিপ
- এডমন্ড বার্টন
- ভিয়েতনাম যুদ্ধ
- ম্যাবো সিদ্ধান্ত
তথ্যসূত্র
- Clark, Manning (1987). *A History of Australia*. Cambridge University Press.
- Davison, Graeme (1988). *Australia: The Years of Hope and Fear*. Oxford University Press.
- Reynolds, Henry (1987). *The Other Side of the Story: Terry Connolly’s Australia*. Penguin Books.
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
