অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স

অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স

ভূমিকা

অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স আধুনিক ব্যবসায়িক জগতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য নির্ভরযোগ্য কিনা, তা যাচাই করাই হলো অডিটের মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, অ্যাসিউরেন্স হলো একটি বিস্তৃত ধারণা, যেখানে অডিট একটি অংশ। অ্যাসিউরেন্স নিশ্চিত করে যে কোনো তথ্য বিশ্বাসযোগ্য এবং ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত। এই নিবন্ধে, আমরা অডিট এবং অ্যাসিউরেন্সের বিভিন্ন দিক, প্রকারভেদ, প্রক্রিয়া এবং গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

অডিট কী?

অডিট হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন, হিসাব এবং তথ্যের একটি স্বাধীন ও নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন। এর মাধ্যমে দেখা হয় যে আর্থিক বিবরণীগুলো হিসাববিজ্ঞান নীতি অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কিনা এবং তাতে কোনো ভুল বা অসঙ্গতি আছে কিনা। অডিট সাধারণত প্রত্যয়িত হিসাববিদ (Chartered Accountant) বা অডিটর দ্বারা পরিচালিত হয়।

অডিটের উদ্দেশ্য

• আর্থিক বিবরণীর যথার্থতা যাচাই করা।
• প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও দায়ের সঠিকতা নিশ্চিত করা।
• হিসাবরক্ষণের নিয়মকানুন সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা, তা দেখা।
• প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করা।
• জালিয়াতি এবং ত্রুটি সনাক্ত করা।
• আর্থিক ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং তা কমানোর উপায় খুঁজে বের করা।

অডিটের প্রকারভেদ

অডিট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:

• অভ্যন্তরীণ অডিট (Internal Audit): এটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এর উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মূল্যায়ন করা এবং উন্নতির সুপারিশ করা। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• বাহ্যিক অডিট (External Audit): এটি প্রতিষ্ঠানের বাইরের স্বাধীন অডিটর দ্বারা পরিচালিত হয়। এই অডিটের মাধ্যমে আর্থিক বিবরণীর উপর মতামত প্রদান করা হয়, যা বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য অংশীজনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
• ট্যাক্স অডিট (Tax Audit): এটি কর কর্তৃপক্ষের দ্বারা আয়কর রিটার্ন যাচাই করার জন্য করা হয়।
• অপারেশনাল অডিট (Operational Audit): এটি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা মূল্যায়ন করার জন্য করা হয়।
• ফোরেনসিক অডিট: এটি জালিয়াতি বা আর্থিক অনিয়ম উদ্ঘাটনের জন্য করা হয়।

অ্যাসিউরেন্স কী?

অ্যাসিউরেন্স হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে কোনো তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করে। অ্যাসিউরেন্সের পরিধি অডিটের চেয়ে অনেক বিস্তৃত।

অ্যাসিউরেন্সের প্রকারভেদ

• আর্থিক বিবরণী অ্যাসিউরেন্স (Financial Statement Assurance): এর মধ্যে বাহ্যিক অডিট অন্যতম।
• কমপ্লায়েন্স অ্যাসিউরেন্স (Compliance Assurance): এটি নিশ্চিত করে যে কোনো সংস্থা আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলছে।
• অপারেশনাল অ্যাসিউরেন্স (Operational Assurance): এটি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা মূল্যায়ন করে।
• সিস্টেমস এবং অর্গানাইজেশনাল কন্ট্রোলস (SOC) রিপোর্ট: এই অ্যাসিউরেন্স রিপোর্টগুলি ডেটা সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা নিশ্চিত করে।

অডিট এবং অ্যাসিউরেন্সের মধ্যে পার্থক্য

| বৈশিষ্ট্য | অডিট | অ্যাসিউরেন্স | |---|---|---| | পরিধি | সংকীর্ণ, শুধুমাত্র আর্থিক বিবরণীর উপর focus করে | বিস্তৃত, আর্থিক এবং অ-আর্থিক উভয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে | | উদ্দেশ্য | আর্থিক বিবরণীর যথার্থতা যাচাই করা | তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করা | | স্বাধীনতা | অডিটর অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে | অ্যাসিউরেন্স প্রদানকারী স্বাধীন নাও হতে পারে | | প্রতিবেদন | অডিট রিপোর্ট | অ্যাসিউরেন্স রিপোর্ট | | নিয়মকানুন | সাধারণত হিসাববিজ্ঞান মান এবং অডিট মান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত | বিভিন্ন মান এবং নির্দেশিকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত |

অডিট প্রক্রিয়া

অডিট একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়। নিচে এই প্রক্রিয়ার ধাপগুলো আলোচনা করা হলো:

১. পরিকল্পনা (Planning): অডিট শুরু করার আগে, অডিটর প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা, আর্থিক অবস্থা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেয়। ঝুঁকি মূল্যায়ন এই পর্যায়ে করা হয়। ২. অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ মূল্যায়ন (Evaluating Internal Controls): অডিটর প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মূল্যায়ন করে দেখে যে এটি কতটা কার্যকর। ৩. প্রমাণ সংগ্রহ (Gathering Evidence): অডিটর বিভিন্ন উৎস থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে, যেমন - চালান, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, চুক্তিপত্র ইত্যাদি। নমুনায়ন কৌশল এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ৪. প্রমাণ বিশ্লেষণ (Analyzing Evidence): সংগৃহীত প্রমাণ বিশ্লেষণ করে অডিটর আর্থিক বিবরণীর যথার্থতা যাচাই করে। ৫. প্রতিবেদন তৈরি (Reporting): অডিটর তার findings এবং মতামত একটি অডিট রিপোর্টে উপস্থাপন করে।

অ্যাসিউরেন্স প্রক্রিয়া

অ্যাসিউরেন্স প্রক্রিয়াও একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে:

১. কাজের সুযোগ নির্ধারণ (Defining the Scope of Work): অ্যাসিউরেন্সের পরিধি এবং উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। ২. ঝুঁকি মূল্যায়ন (Risk Assessment): অ্যাসিউরেন্সের সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলো মূল্যায়ন করা হয়। ৩. প্রমাণ সংগ্রহ ও মূল্যায়ন (Gathering and Evaluating Evidence): প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করে তার নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয়। ৪. অ্যাসিউরেন্স রিপোর্ট তৈরি (Preparing the Assurance Report): অ্যাসিউরেন্সের ফলাফল একটি রিপোর্টে উপস্থাপন করা হয়।

অডিট এবং অ্যাসিউরেন্সের গুরুত্ব

• বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি: নির্ভরযোগ্য আর্থিক বিবরণী বিনিয়োগকারীদের সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
• ঋণদাতাদের সুরক্ষা: ব্যাংক এবং অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলি ঋণ দেওয়ার আগে আর্থিক বিবরণী যাচাই করে।
• কর্পোরেট গভর্নেন্সের উন্নতি: অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স কর্পোরেট গভর্নেন্সের মান উন্নত করে।
• জালিয়াতি প্রতিরোধ: নিয়মিত অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স জালিয়াতি এবং আর্থিক অনিয়ম প্রতিরোধ করতে সহায়ক।
• আইনগত বাধ্যবাধকতা: অনেক দেশে অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক।

অডিট কৌশল এবং পদ্ধতি

অডিটররা বিভিন্ন কৌশল এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে অডিট সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিচে উল্লেখ করা হলো:

• বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি (Analytical Procedures): আর্থিক তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করা।
• বিস্তারিত পরীক্ষা (Detailed Testing): লেনদেন এবং ব্যালেন্সের বিস্তারিত পরীক্ষা করা।
• সম্মতি পরীক্ষা (Compliance Testing): প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন এবং নীতিগুলি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করা।
• সাবস্ট্যান্টিয়াল টেস্টিং: লেনদেনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সরাসরি প্রমাণ সংগ্রহ করা।

ভলিউম বিশ্লেষণ (Volume Analysis)

ভলিউম বিশ্লেষণ হলো ডেটার পরিমাণ এবং প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিকতা খুঁজে বের করার একটি কৌশল। এটি ডেটা বিশ্লেষণ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

• প্রবণতা বিশ্লেষণ (Trend Analysis): সময়ের সাথে সাথে ডেটার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা।
• অনুপাত বিশ্লেষণ (Ratio Analysis): বিভিন্ন আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করা।
• বেনচমার্কিং: অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করে নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করা।

প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ (Technical Analysis)

প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ হলো ঐতিহাসিক ডেটা ব্যবহার করে ভবিষ্যতের প্রবণতাPredict করার একটি পদ্ধতি।

• চার্ট এবং গ্রাফ ব্যবহার: ডেটা visually উপস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন চার্ট এবং গ্রাফ ব্যবহার করা হয়।
• মুভিং এভারেজ: নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেটার গড় মান বের করে প্রবণতা সনাক্ত করা।
• রিগ্রেশন বিশ্লেষণ (Regression Analysis): দুটি চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা।

ঝুঁকি-ভিত্তিক অডিট (Risk-Based Audit)

ঝুঁকি-ভিত্তিক অডিট হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী অডিট কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

• উচ্চ ঝুঁকি চিহ্নিত করা: প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা।
• ঝুঁকির মূল্যায়ন: প্রতিটি ঝুঁকির সম্ভাবনা এবং প্রভাব মূল্যায়ন করা।
• নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা: ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরীক্ষা করা।

অডিট সফটওয়্যার

বর্তমানে, অডিট প্রক্রিয়াকে আরও efficient করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অডিট সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।

• ACL (Audit Command Language)
• IDEA (Interactive Data Extraction and Analysis)
• CaseWare Working Papers

উপসংহার

অডিট এবং অ্যাসিউরেন্স একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়াগুলি বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা এবং অন্যান্য অংশীজনদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আধুনিক ব্যবসায়িক পরিবেশে, অডিট এবং অ্যাসিউরেন্সের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে, এবং এই বিষয়ে জ্ঞান রাখা সকলের জন্য প্রয়োজন।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ